হিজাব-বিতর্কে কার্যত জীবনই পাল্টে গিয়েছে কর্নাটকের ছয় ছাত্রী ও তাঁদের পরিবারের। ফাইল চিত্র।
সব ঠিকানা বদলে গিয়েছে।
বদলে গিয়েছে ঘর। শ্রেণিকক্ষ। ছাড়তে হয়েছে রাজ্য। হিজাব-বিতর্কে কার্যত জীবনই পাল্টে গিয়েছে কর্নাটকের ছয় ছাত্রী ও তাঁদের পরিবারের। নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও হিজাব পরে আসায় সরকারি প্রি-ইউনিভার্সিটি কলেজ ওই ছাত্রীদের সাসপেন্ড করেছিল আগেই। মামলা এখনও চলছে সর্বোচ্চ আদালতে। আর আজন্ম বেড়ে ওঠার উদুপির ঠিকানা ছেড়ে নতুন শহরে, নতুন ক্লাসে, জীবনের লড়াই যুঝছেন ওই ছাত্রীরা।
পাল্টেছে আর এক ব্যক্তির জীবনও। যশপাল সুবর্ণ। তাঁর হাত ধরে হিজাব-বিতর্কের সূত্রপাত। সেই হিন্দুত্বের হাওয়ায় ভর করে কর্নাটকের বিধানসভা ভোটে উদুপি থেকে বিজেপির টিকিট ছিনিয়ে নিয়েছেন কট্টর হিন্দুত্ববাদী নেতা যশপাল। টিকিট পেলেন না কে? ওই কেন্দ্রের বর্তমান বিজেপি বিধায়ক তথা যশপালেরই এক সময়ের গুরু রঘুপতি ভাট!
হিজাব-বিতর্ক শুরু হতেই সংবাদমাধ্যমের স্রোত। সঙ্গে ছিল গেরুয়াধারীদের হুমকি ও বাড়িতে হামলার অভিযোগ। রাজ্যের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দরজাও বন্ধ। ফলে মেয়েকে ভিন্ রাজ্যে পাঠিয়ে দেওয়া ছাড়া কোনও উপায় ছিল না বলেই ফোনে জানালেন এক ছাত্রীর বাবা শুকুর মালপে। হিজাব-বিতর্কের পরেই বাড়ি বদলে ফেলেছেন। নতুন ঠিকানা জানাবেন না, তাই দেখা করেন না সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে। কথা বলেন শুধু ফোনেই। বললেন, ‘‘ওই ঘটনার অভিঘাতে জল এত দূর গড়ায় যে, মেয়েকে ভিন্ রাজ্যে পাঠাতে বাধ্য হই। এখানে থাকলে মেয়ে এ বার দ্বাদশ শ্রেণিতে উঠত। কিন্তু অন্য রাজ্যে সেই একাদশেই ভর্তি করাতে হয়েছে। এক বছর নষ্ট হল।’’ ভোটের মরসুমে আপাতত মেয়েকে বাড়িতে আসতেও বারণ করে দিয়েছেন শুকুর।
শান্ত উদুপিতে হঠাৎ করে হিজাব পরা না-পরা নিয়ে বিতর্ক কেন তৈরি হল, তা সেই সময়ে ধরতে পারেননি শুকুররা। এখন কিছুটা দু’য়ে দু’য়ে চার করতে পারছেন— গোটা বিতর্ককে হাওয়া দিয়ে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের নজর কেড়ে নেওয়া যশপাল সুবর্ণই বিজেপির প্রার্থী হওয়ার পরে। শুকুর বলেন, ‘‘এখন বুঝি, হিজাব-বিতর্কের জন্যই টিকিট নিশ্চিত হয়েছে যশপালের।’’ যশপাল জিতলে মেয়েকে উদুপিতে ফেরানোর প্রশ্নই নেই, জানা দিলেন শুকুর।
যশপালের বিরুদ্ধে লড়তে এ বার কংগ্রেসের হয়ে উদুপির ভোটের ময়দানে নেমেছেন প্রসাদ রাজ কাঞ্চন। মা এক সময়ে কংগ্রেসের বিধায়ক ছিলেন। কিন্তু প্রসাদ নিজে শিল্পপতি, রাজনীতিতে আনকোরা। ফলে তাঁর পক্ষে আদৌ কতটা চ্যালেঞ্জ দেওয়া সম্ভব, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে স্থানীয় কর্মীদের মধ্যেই। উদুপির প্রেস ক্লাবের পাশেই কংগ্রেসের প্রধান দফতর। ভোটের ১০ দিন আগেও সেই দফতর খাঁ-খাঁ করছে। উদুপির আয়ের মূল উৎস মাছের ব্যবসা। তাই মাছ ধরতে যাওয়া নৌকার জন্য ভর্তুকিতে ডিজ়েল দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে গিয়েছেন রাহুল গান্ধী। তাতে উজ্জীবিত কংগ্রেস কর্মীরা মনে করছেন, মৎস্যজীবী সমাজের ভোট তাঁদের ঘরে আসতে চলেছে। এ বারের ভোটে এখানকার বিজেপি, কংগ্রেস ও জেডিএসের তিন প্রার্থীই মোঘাবিরা বা জেলে সম্প্রদায়ের। তাই রাহুলের প্রতিশ্রুতি বিশেষ প্রভাব ফেলবে না বলেই মনে করেন যশপাল। বিজেপি দফতরে বসে মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে বললেন, ‘‘রাহুল গান্ধী কী বলে গেলেন, তাতে কেউ বিশ্বাস করে না। ভর্তুকির টাকা আসবে কোথা থেকে? সেই জনগণের টাকাই দেওয়া হবে।’’ তাঁর দাবি, মোঘাবিরা-রা বিজেপির সঙ্গে ছিলেন, ভবিষ্যতেও থাকবেন। তাই যশপাল আত্মবিশ্বাসী, বড় অঘটন না ঘটলে উদুপিতে হিন্দুত্বের চোরাস্রোতেই তাঁর জয় নিশ্চিত। উদুপি সংলগ্ন আরও অন্তত চারটি আসনেও গত বারের মতো জয় দেখছেন বিজেপি নেতৃত্ব।
আপাত শান্ত উদুপিতে পরিস্থিতি অনুকূলে মনে করছেন বলেই হিজাব নিয়ে নতুন করে একটি শব্দও আর প্রকাশ্যে খরচ করছেন না বিজেপি নেতারা। এমনকি যশপালও এড়িয়ে চলছেন ওই বিতর্ক। পরিবর্তে উন্নয়নের মডেলকে হাতিয়ার করে প্রচারে নেমেছেন তিনি। কিন্তু বিভেদের যে সুর তিনিই বেঁধে দিয়েছেন, তা ক্রমশ দানা বাঁধছে একদা ধর্মনিরপেক্ষ ওই জনপদে। উদুপি টাউন স্কুলের সামনে বাস ধরার জন্য দাঁড়িয়ে ছিল বেশ কয়েক জন স্কুল ছাত্রী। দশম শ্রেণির ছাত্রী তানিশার গলাতেই বিভেদের সেই সুর স্পষ্ট। সে বলল, ‘‘হিজাব-বিতর্কের পরে বেশ কিছু বন্ধু স্কুলে আসা বন্ধ করে দিয়েছে। পড়া না হিজাব পরা, কোনটা বেশি জরুরি, তা ওরাই ঠিক করুক।’’
স্থানীয়দের মত, প্রকাশ্যে না হলেও, গত দেড়-দু’বছর ধরে ধারাবাহিক ভাবে ঘরে-ঘরে গিয়ে হিজাব-প্রসঙ্গ, সঙ্ঘ কর্মীর হত্যা এবং তাতে মুসলিম সংগঠন পপুলার ফ্রন্ট অব ইন্ডিয়া (পিএফআই)-র দিকে অভিযোগের আঙুল ওঠা, সংগঠনটির নিষিদ্ধ হওয়া— ইত্যাদি নিয়ে লাগাতার সংখ্যালঘু-বিরোধী প্রচার চালিয়ে গিয়েছে বিজেপি-আরএসএস। তা ক্রমশ বিরূপ প্রভাব ফেলেছে স্থানীয়দের মনে। আড়াআড়ি বিভাজনও ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে। তানিশার মতো স্কুলপড়ুয়াদেরও তা ছুঁয়ে ফেলছে! হোটেল মালিক মঞ্জুনাথের আক্ষেপ, ‘‘পরিস্থিতি দ্রুত পাল্টাচ্ছে। বিভাজন বাড়ছে। অতীতে হিজাব পরে পড়ুয়ারা আসত। কারও সমস্যা ছিল না। হঠাৎ করে ওই বিতর্ক হল, আর রাজ্যের সমস্ত স্কুলে হিজাবে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়ে গেল।’’ তিনি মনে করেন, সম্ভবত বছরখানেক আগেই হারের গন্ধ পেয়ে হিন্দুত্বের পালে হাওয়া দিতে হিজাব-বিতর্ক উস্কে দিয়ে পরিকল্পিত পদক্ষেপ করে বিজেপি।
উদুপির শ্রীকৃষ্ণ মন্দিরের ঠিক বাইরেই চাটের দোকান। হিজাব পরা মহিলারা যেমন হাসতে হাসতে চাট খাচ্ছেন, মন্দির থেকে বেরিয়ে ভক্তেরাও পেট ভরাতে মিশে যেতে দ্বিধা করছেন না সেই ভিড়ে। কিন্তু কত দিন? ক্ষমতা দখলে বিভাজনের যে বিষবৃক্ষের চারা যশপালেরা পুঁতেছেন, তা অজানতেই শিকড় ছড়াচ্ছে উদুপির নোনা জমিতে।