দক্ষিণের একমাত্র রাজ্যে আসন টলোমলো বিজেপির। ফাইল চিত্র।
ক্ষমতায় ছিলেন মেরেকেটে দু’বছর। তাতেই পুকুর চুরি, কমিশনখোরের তকমা আর প্রশাসনিক ব্যর্থতার অভিযোগে কুর্সি বেসামাল মুখ্যমন্ত্রী তথা লিঙ্গায়েত-নেতা বাসবরাজ বোম্মাইয়ের। দক্ষিণের একমাত্র রাজ্যে আসন টলোমলো বিজেপির। শেষ পর্যন্ত বিজেপি যদি কর্নাটকে জেতে, তা হলে ‘প্রশাসন সামলাতে অদক্ষ’ বোম্মাইকে ফের মুখ্যমন্ত্রী করা হবে কি না, তা নিয়ে বেশ দ্বিধায় রাজ্য নেতৃত্ব। এই দোটানার সুযোগে প্রচারের শেষ বেলায় মুখ্যমন্ত্রিত্বের দৌড়ে ‘ডার্ক হর্স’ হিসেবে ক্রমশ দূরত্ব কমাচ্ছেন ভোক্কালিগা-নেত্রী শোভা কারনদলাজে। দৌড়ে রয়েছেন কেন্দ্রীয় নেতা প্রহ্লাদ জোশী, বি এল সন্তোষ, সি টি রবির মতো নেতাও। রয়েছেন, কংগ্রেসের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী সিদ্দারামাইয়ার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো লিঙ্গায়েত নেতা ভি সোমান্নাও।
বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী বদলের জল্পনার মধ্যেই কর্নাটকের জাতিগোষ্ঠীগুলির অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সমীকরণেও সমর্থন বদলের ইঙ্গিত দেখা যাচ্ছে। ২০২১ সালের জুলাই মাসে মুখ্যমন্ত্রী পদ থেকে বি এস ইয়েদুরাপ্পাকে সরিয়ে দেওয়ার পর থেকেই বিজেপির পিছন থেকে সরতে শুরু করে লিঙ্গায়েত ভোট। এ বারের ভোটে ইয়েদুরাপ্পা বা তাঁর পরিবারের কাউকে মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে তুলে না-ধরা এবং ‘অন্তর্ঘাত’ করে ইয়েদুরাপ্পাকে দুর্বল করে দেওয়ার অভিযোগে ফুঁসছে লিঙ্গায়েত সমাজের একটা বড় অংশ। ফলে যে লিঙ্গায়েত ভোট দুর্ভেদ্য দুর্গের মতো গত দু’দশকের বেশি সময় ধরে বিজেপির পাশে দাঁড়িয়েছিল, তাতে এ বার ভাঙনের চিহ্ন স্পষ্ট। দল থেকে বেরিয়ে গিয়েছেন জগদীশ শেট্টার ও লক্ষ্মণ সাদাভির মতো শীর্ষ লিঙ্গায়েত নেতারা, যাঁরা উত্তর কর্নাটকে অন্তত ১০টি আসনে বিজেপিকে অস্বস্তিতে ফেলতে পারেন বলে মনে করা হচ্ছে। লিঙ্গায়েত ভোট সরে যাওয়ার ইঙ্গিত পাওয়ার পর থেকেই তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে পরিচিত ভোক্কালিগা সমাজকে কাছে টানার কৌশল নিয়ে এগোতে শুরু করে বিজেপি। তাই দলে ক্রমশ গুরুত্ব বেড়েছে ভোক্কালিগা নেত্রী শোভার।
কর্নাটকের ঘরোয়া রাজনীতিতে গোড়া থেকেই ইয়েদুরাপ্পার ঘনিষ্ঠ বলে পরিচত ছিলেন শোভা। মামুলি রাজনৈতিক কর্মী থেকে তাঁর কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হয়ে ওঠার পিছনে বড় ভূমিকা রয়েছে ইয়েদুরাপ্পার। বেঙ্গালুরুর কোরমঙ্গলায় বিজেপির দলীয় দফতরে বসে শোভার দ্বিতীয় ইনিংসে কামব্যাক প্রসঙ্গে বিজেপি কর্মী নাগরাজ হোলিবানে জানালেন, “ইয়েদুরাপ্পার কুর্সি যেতেই রাজ্যে ক্ষমতার অক্ষের পরিবর্তন হয়। লিঙ্গায়েতদের মধ্যে অসন্তোষ দেখে দল ভোক্কালিগাদের মধ্যে জনভিত্তি বাড়ানোর পরিকল্পনা নেয়। সে সময়ে শোভাকে বলা হয়েছিল রাজনৈতিক জীবন বাঁচাতে হলে ইয়েদুরাপ্পা শিবির ছাড়তে হবে। সেটাই করেন তিনি।” ফলে, ভোটের বাজারে ক্রমশ গুরুত্ব বেড়েছে শোভার। তাঁকে সামনে রেখে গোটা রাজ্যে প্রচারে নামে বিজেপি।
সম্প্রতি বজরং দলকে নিষিদ্ধ করার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি দিয়েছে কগ্রেস। পাল্টা পদক্ষপ হিসেবে কর্নাটকে বিজেপি কর্মীরা বাড়ি বাড়ি ‘হনুমান চালিশা’ পড়ার কর্মসূচি গ্রহণ করে। সেই আন্দোলনের মুখও করা হয়েছে শোভাকে। তা ছাড়া, শোভা মুখ্যমন্ত্রী হলে দেশ জুড়ে মহিলা সমাজের কাছে ইতিবাচক বার্তা দেওয়া সম্ভব হবে বলে মনে করছেন বিজেপি নেতৃত্ব— যা প্রভাব ফেলতে পারে আগামী বছরের লোকসভা ভোটে।
বেঙ্গালুরু-সংলগ্ন মান্ডিয়া, হাসানের মতো জেলাগুলি ভোক্কালিগা অধ্যুষিত। এখানকার অধিকাংশ মানুষ এতদিন চোখ বুজে ভোট দিয়ে এসেছেন কংগ্রেস বা জেডিএস প্রার্থীদের। বিজেপি ভোক্কালিগা নেতৃত্বকে গুরুত্ব দিতে শুরু করায় সেই জনসমর্থনে এ বার ফাটল স্পষ্ট। সপ্তাহান্তে বেঙ্গালুরুতে নিজের কর্মস্থলে ফিরে যাওয়ার জন্য মান্ডিয়া বাস স্ট্যান্ডে অপেক্ষা করছিলেন তথ্যপ্রযুক্তি কর্মী প্রিয়রাজন। রাজনীতিতেও তাঁর প্রবল উৎসাহ। প্রিয়রাজনের পর্যবেক্ষণ, “এ বারের ভোটে তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে ভোক্কালিগা নেতৃত্বকে সামনে তুলে আনার কৌশল নিয়েছে বিজেপি। শোভার পাশাপাশি মুখ্যমন্ত্রিত্বের দৌড়ে রয়েছেন বিধায়ক তথা দলের মধ্যে কট্টর হিসাবে পরিচিত জাতীয় সাধারণ সম্পাদক সি টি রবি। ফলে বিজেপিকে নিয়ে উৎসাহ বাড়ছে ভোক্কালিগা সমাজে।’’
ভোক্কালিগা নেতা রবি সম্প্রতি দাবি করেছিলেন, মাইসুরুর ‘হিন্দুবিদ্বেষী’ সম্রাট টিপু সুলতান ব্রিটিশদের নয়, ভোক্কালিগা সম্প্রদায়ের নেতা উরি ও নানজে গৌড়ার হাতে প্রাণ হারিয়েছিলেন। লক্ষ্য ছিল, বিজেপির পক্ষে হিন্দু তথা ভোক্কালিগা ভোটের মেরুকরণ। ইতিহাসবিদ, কংগ্রেস আর জেডিএস নেতৃত্ব ছাড়াও ভোক্কালিগাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মঠ আদি চুনচুনগিরি-কর্তৃপক্ষ রবির ওই ভিত্তিহীন দাবি খারিজ করে দিয়েছেন। বলা হয়েছে, উরি ও নানজে গৌড়া কাল্পনিক চরিত্র। তাতে বিজেপি সাময়িক ভাবে অস্বস্তিতে পড়লেও ভোক্কালিগাদের কাছে টানার প্রশ্নে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে এগোনোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে দল।
তবে একেবারে হাল ছাড়তে নারাজ লিঙ্গায়েতরা। তাঁদের সব চেয়ে বড় বাজি ভি সোমান্না। কংগ্রেসের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী সিদ্দারামাইয়াকে বরুণা কেন্দ্রে হারাতে পারলে সোমান্না যে মুখ্যমন্ত্রিত্বের দৌড়ে অনেকটাই এগিয়ে যাবেন, সে বিষয়ে নিশ্চিত লিঙ্গায়েত সমাজ।