রাজ্যের প্রায় প্রতিটি কোণে প্রতিষ্ঠান-বিরোধী হাওয়া। প্রতীকী ছবি।
‘‘চল্লিশ শতাংশ কমিশন সর্বত্র। সব সরকারি প্রকল্পে। চাহিদা মেটাতে না পেরে আত্মহত্যা করেছেন এক ঠিকাদার। পারলে মৃতদেহের কাছ থেকেও কমিশন চাইতে পারে এই নেতারা।’’
কন্নড় ভূমিতে এক নিঃশ্বাসে স্পষ্ট হিন্দিতে কথাগুলি বলে থামলেন অটোচালক রশিদ। বেঙ্গালুরুরক ম্যাজেস্টিক বাস স্ট্যান্ড থেকে বেরিয়ে রশিদকে প্রশ্ন করেছিলাম, বিজেপির ক্ষমতা ধরে রাখার সম্ভাবনা কতটা। যে প্রবল সমালোচনায় তিনি সরব হলেন, তা রোখে কার সাধ্য! বিজেপি-মুসলিম আদায় কাঁচকলায় সম্পর্ক। তাই হয়তো রশিদ বিজেপি-বিরোধী। কিন্তু রশিদ ছাড়াও, মেঙ্গালুরুতে নামার পরে প্রথম আলাপ হওয়া ট্যাক্সিচালক বিনোদ, উদুপীর বর্ষীয়ান স্থানীয় সাংবাদিক থেকে শিকারিপুরে বি এস ইয়েদুরাপ্পার ছেলে বিজয়েন্দ্রর ব্যক্তিগত সচিব হরিশ— সকলেই একমত, দুর্নীতির এমন পাঁকে বিজেপিকে আগে কখনও পড়তে হয়নি। কাটমানি দিতে না পেরে ঠিকাদারের আত্মহত্যার অভিযোগ ভোট প্রচারের গোড়া থেকে শেষ দিন পর্যন্ত তাড়িয়ে বেড়িয়েছে প্রধানমন্ত্রীর দলকে। দুর্নীতির ওই চক্রব্যূহতে দল ঢুকেছে ঠিকই, কিন্তু অভিমন্যুর মতোই বেরিয়ে আসার পথ খুঁজে পেতে ব্যর্থ বিজেপি নেতৃত্ব।
রাজ্যের প্রায় প্রতিটি কোণে প্রতিষ্ঠান-বিরোধী হাওয়া। এমন নয় তা কেবল ভোটের আগেই তৈরি হয়েছে। প্রথম আড়াই-তিন বছরের মধ্যেই এই সরকারের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়তে শুরু করেছিল রাজ্যবাসী। একের পর এক উপনির্বাচনে জিততে শুরু করে কংগ্রেস। সেটা দেখেই ইয়েদুরাপ্পাকে সরিয়ে বাসবরাজ বোম্মাইকে মুখ্যমন্ত্রী পদে নিয়ে আসা হয়। কিন্তু হাওয়ার প্রতিকূলে পাল খাটিয়ে এগোনো তো দূরে থাক, প্রশাসনিক অনভিজ্ঞতার কারণে পুকুর চুরি শুরু হয়ে যায় নতুন মুখ্যমন্ত্রিত্বে। সরকারি প্রকল্প থেকে মন্ত্রীদের কমিশনের মাত্রা বাড়তে বাড়তে ৪০ শতাংশে গিয়ে পৌঁছয়। অভিযোগ, যা দিতে না পেরে আত্মহত্যা করেন এক ঠিকাদার। সব মিলিয়ে জনমানসে বিষয়টি যে ভাবে নাড়া দিয়েছে, তাতে এ যাত্রায় গোড়া থেকেই ব্যাকফুটে ছিল নরেন্দ্র মোদীর দল। এমনকি খোদ প্রধানমন্ত্রীও বিতর্ক থেকে বাঁচতে পারেননি। মন্ত্রীদের কমিশন খাওয়ার বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখে জানিয়েছিল রাজ্যের ঠিকাদার সংগঠন। চিঠির প্রাপ্তিস্বীকার কেন প্রধানমন্ত্রী করেননি, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন রাহুল গান্ধী। অন্য দিকে গত দু’সপ্তাহ ধরে টানা কর্নাটকে প্রচার করে দুর্নীতি প্রসঙ্গে একটি শব্দও খরচ করেননি নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহেরা। উল্টে বিজেপি হিন্দুত্বের পুরনো পথে হাঁটার কৌশল নিলেও সরকার কি বাঁচানো সম্ভব হবে তাতে? প্রশ্ন দলের অভ্যন্তরেই।
বেঙ্গালুরু থেকে সামান্য দূরেই জয়ানগর কেন্দ্র। সেখান থেকে বিজেপির প্রার্থী হয়েছেন সি কে রামমূর্তি। দিনের শেষে প্রচার সেরে সময় দিলেন কথা বলার জন্য। গোড়ায় বুক ঠুকে জিতবেন বলে দাবি করলেও আলাপচারিতা একটু এগোলেই স্পষ্ট বোঝা গেল, রাজ্য মন্ত্রিসভার দুর্নীতিতে প্রবল ক্ষুব্ধ তিনিও। বিশেষ করে প্রাক্তন গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রী ঈশ্বরাপ্পা যে ভাবে কাটমানি খেয়েছেন, তাতে রাজ্যে বিজেপির জেতার সম্ভাবনা শেষ বলে আক্ষেপ করছেন ওঁর মতো অনেকেই। তাঁর মতে, ‘‘যে দল এত দিন কংগ্রেসের দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরব থেকেছে, আজ তাদেরই দুর্নীতির অভিযোগের মোকাবিলা করতে হচ্ছে।’’ ঘরোয়া ভাবে বিজেপি কর্মীরা মেনে নিচ্ছেন, যে ভাবে তাঁদের নেতাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে এবং মানুষ যে ভাবে সেই অভিযোগ বিশ্বাস করে নিয়েছেন তাতে ‘মিরাকল’ না হলে দলের পক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া মুশকিল।
বিজেপি নেতৃত্বের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ বিক্ষিপ্ত ভাবে উঠছিল অনেক দিনই। তবে বিজেপি শিবিরের মতে, ওই অভিযোগ রাজ্যের সর্বত্র, সর্ব স্তরে যে ভাবে ছড়িয়েছে তার পিছনে পরিকল্পিত পদক্ষেপের উপস্থিতি স্পষ্ট। ওই মসৃণ নেটওয়ার্কের পিছনে কর্নাটক কংগ্রেসের অন্যতম নেতা ডি কে শিবকুমারের ভূমিকা রয়েছে বলেই অনেকে মনে করছেন। রাহুল বা সনিয়া গান্ধীরা প্রচারে এসে দুর্নীতির বিষয়টি তুললেও, তা জনমানসে গেঁথে দেওয়ার পিছনে গত ছয় মাস ধরে তৎপর ছিল কংগ্রেসের একাংশ। যাদের পিছন থেকে মদত দিয়ে গিয়েছেন শিবকুমার। বেঙ্গালুরু থেকে ষাট কিলোমিটার দূরেই শিবকুমারের কেন্দ্র কনকপুরা। জেতার বিষয়ে নিশ্চিত শিবকুমার এ যাত্রায় বিশেষ সময় দেননি নিজের কেন্দ্রে। উল্টে ৪০ শতাংশ কমিশন ও বিজেপির দুর্নীতি নিয়ে প্রচার চালিয়েছেন রাজ্য জুড়ে। যে মহাবাণের কোনও জবাব ছিল না কোনও বিজেপি নেতার কাছেই।