কানপুরের ছেলে নিতিন কুমারের মা গৃহ পরিচারিকার কাজ করতেন। বাবারও ঠিকমতো কাজ জুটত না। দু’জনে মিলে যা উপার্জন করতেন, তা দিয়ে সকলের মুখে অন্ন জোগানোই দায় ছিল। সেখানে ছেলেদের স্কুলের মাইনে তো দূর অস্ত।
তাঁর মা যে সমস্ত বাড়িতে পরিচারিকার কাজ করতেন, সেখান থেকেই উচ্ছিষ্ট যা খাবার নিতে আসতেন, সেগুলি খেয়েই পেট ভরাতেন নিতিন এবং তাঁর দাদা। আর মা-বাবা? মাসের বেশির ভাগ দিনই তাঁদের দিনের শুরু এবং শেষ হত চিনি গোলা মিষ্টি জল খেয়েই।
তবে এই দারিদ্রের মধ্যেও ছোট থেকে নিতিনের পড়াশোনার ঝোঁক ছিল। নিতিন এবং তাঁর দাদাকে সরকারি স্কুলে ভর্তিও করে দিয়েছিলেন মা-বাবা। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর দাদা উপার্জনের রাস্তায় হাঁটা দেন। নিতিন কিন্তু হাল ছাড়েননি।
ক্লাসে যা শিখতেন, সেটুকুই ছিল তাঁর সম্বল। বাকি সব নিজেকেই অনুশীলন করে নিতে হত। কারণ সহপাঠীদের মতো আলাদা টিউশন নেওয়ার সামর্থ্য তাঁর ছিল না।
খাতা, বই, পেন, স্কুলের পোশাক-এগুলোও ঠিকমতো কিনে উঠতে পারতেন না নিতিন।
কানপুরের ছেলে নিতিন সেই পরিস্থিতির মধ্যে থেকেই নিজের চেষ্টায় আইন নিয়ে পড়াশোনা করছেন। চলতি বছরেই স্নাতক হবেন।
নিতিন আজ অনেকটাই বড় হয়ে গিয়েছেন। একাই মা-বাবার দেখাশোনা করেন। তাঁদের জীবনযাপনেও অনেক বদল এসেছে। তা বলে অতীতকে ভুলে যাননি নিতিন। ভুলতে পারেননি বলেই তাঁর মতো ২০০ গরিব ছেলেমেয়েকে ভাল জীবন উপহার দিতে আজ বিনামূল্যে পড়াচ্ছেন।
কানপুরে তাঁর বাড়ির কাছে একটি নদীর ধারে স্কুল খুলে ফেলেছেন তিনি। খোলা আকাশের নীচে অতিমারি পরিস্থিতির আগে পর্যন্ত রোজ সন্ধ্যায় সেখানেই নার্সারি থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ুয়াদের ক্লাস নিতেন। স্কুলের নাম রেখেছেন ‘ঘাটওয়ালা স্কুল’।
পথচলতি মানুষ নিতিনের এই উদ্যোগে অনুপ্রাণিত হয়ে কেউ অর্থ সাহায্য করতেন, তো কেউ নিতিনের মতোই পড়ুয়াদের ক্লাস নিতে এগিয়ে আসতেন। শুধু বিনামূল্যে টিউশনই দিতেন না, নিতিন শিক্ষার্থীদের স্কুলে ভর্তির টাকাও অনেক সময় দিয়ে দেন।
বাংলা, ইংরাজি থেকে বিজ্ঞান, এমনকি সংস্কৃত এবং ফরাসি ভাষাও শিখছে নিতিনের স্কুলের পড়ুয়ারা।
নিজে স্কুলে পড়ার সময় থেকেই নিতিন এই স্কুল চালু করে দিয়েছিলেন। প্রথম প্রথম খুব একটা পড়ুয়া হত না। নিতিন দ্বাদশ শ্রেণি পাশ করার পরই মূলত তাঁর কাছে পড়তে শুরু করে এলাকার বহু দরিদ্র পরিবারের ছেলেমেয়েরা।
অনেক বার ছাত্র-ছাত্রীদের বাড়িতে গিয়ে অভিভাবকদের বুঝিয়ে স্কুলছুটের হাত থেকে তাদের বাঁচাতে হয়েছে নিতিনকে।
নিতিনের সঙ্গে আরও অনেকে যোগ দিয়েছেন এই কাজে। নিতিনের আইন কলেজের শিক্ষকদের অনেকেই এগিয়ে এসেছেন।
অতিমারিতে নিতিনের ‘ঘাটওয়ালা স্কুল’ একটু সমস্যার মুখোমুখি পড়েছে। ছোট একটি ঘর ভাড়া নিয়ে ক্লাস নিতে হচ্ছে। লোকের চোখের আড়ালে চলে যাওয়ায় অর্থসাহায্যের পরিমাণও কমেছে। অল্প কিছু সাহায্য থেকে ঘর ভাড়ার টাকা কোনওক্রমে উঠে আসছে, কিন্তু ছাত্রদের স্কুল ভর্তির টাকার জোগানে ঘাটতি দেখা দিয়েছে।
বাধা পেরিয়ে নিজে পড়াশোনা চালিয়ে গিয়েছিলেন নিতিন। বাধা পেরিয়ে স্কুলটিকেও এগিয়ে নিয়ে যাবেন, ছাত্র-ছাত্রীদের সুন্দর জীবন উপহার দিতে পারবেন, আত্মবিশ্বাসী তিনি।