মাশুল গুনেছেন দু’জনেই।
আর কারণগুলিও কতকটা এক।
উভয়ের আচরণে ঔদ্ধত্য ছলকে পড়ে। দু’জনেরই বিচক্ষণতার অভাব। দু’জনেই অতি-সক্রিয়। সংযম হারিয়ে লক্ষণরেখা কখন পার করে ফেলেন, টের পান না।
মানবসম্পদ উন্নয়নমন্ত্রক থেকে স্মৃতি ইরানির বিদায়ের ছায়ায় ঢাকা পড়ে গিয়েছিল আর একটি বড় পতন। অর্থমন্ত্রকের প্রতিমন্ত্রীর পদ থেকে জয়ন্ত সিনহাকে অপসারণ করে তাঁকে অপেক্ষাকৃত লঘু বিমান পরিবহণ মন্ত্রকের প্রতিমন্ত্রী করে পাঠানো হয়েছে। অথচ, আইআইটি, হার্ভার্ড গ্র্যাজুয়েট ৫৩ বছরের এই ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্কার যখন প্রথম বার সাংসদ হয়ে নর্থ ব্লকে প্রবেশ করেন, অনেকেই ভেবেছিলেন এই পদের জন্য তিনিই সেরা বাছাই। কিন্তু সরকারের দু’বছর পূর্ণ হওয়ার পরেই নরেন্দ্র মোদীর বিস্ফোরক রদবদলে সরতে হল দু’জনকেই।
স্বাভাবিক ভাবে এতটাই বিষণ্ণ তাঁরা, অর্থমন্ত্রকে নতুন প্রতিমন্ত্রীদের দায়িত্ব গ্রহণের সময় হাজির থাকলেন না জয়ন্ত। ঠিক যেমনটি আজ নতুন মানবসম্পদ উন্নয়নমন্ত্রী প্রকাশ জাভড়েকরের দায়িত্ব নেওয়ার সময় থাকলেন না তাঁর পূর্বসূরী স্মৃতি।
বিজেপির অনেকেই দুই মন্ত্রীর এ হেন আচরণেও উভয়ের মধ্যে মিল খুঁজে পাচ্ছেন। দলের এক নেতা তো বলেই ফেললেন, ‘‘আমাদের দলে কত তাবড় তাবড় নেতা মন্ত্রী হওয়ার জন্য মুখিয়ে রয়েছেন। কিন্তু এঁরা সেই সুযোগ পেয়েও নিজের পায়ে কুড়ুলটি মারলেন।’’
কী ভাবে?
জয়ন্ত সিনহার ঘনিষ্ঠ মহল অবশ্য বলছে, তাঁকে যে ভাবে অর্থমন্ত্রক থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে, তা আদৌ প্রত্যাশিত ছিল না। কিন্তু বিজেপির অন্দরে কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে, জয়ন্ত সিনহার বিরুদ্ধে ভুরি ভুরি ক্ষোভ-অভিযোগ। দলের নেতাদের ব্যাখ্যা, প্রথমত অর্থমন্ত্রকের অনেক সিদ্ধান্ত না জেনেবুঝেই তিনি প্রকাশ্যে বলে ফেলতেন। সংসদ চলার সময় একটি স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে সাংবাদিকদের সামনে আগ বাড়িয়ে মুখ খুললেন, যা নিয়ে শেয়ার বাজারেও তীব্র প্রতিক্রিয়া হল। এক বার তো সাংবাদিক সম্মেলনে বলে ফেললেন, আয়করদাতার সংখ্যা দ্বিগুণ বাড়িয়ে দশ কোটি করা হবে। পরে সেটিকে সামাল দিতে হিমশিম খেতে হয় গোটা অর্থমন্ত্রককে।
আরও পড়ুন: স্মৃতি-রঙ্গে মজে নেট দুনিয়া
প্রধানমন্ত্রী সচিবালয় সূত্রের খবর, এ ভাবে আগ বাড়িয়ে কথা না বলার জন্য সতর্কও করা হয় জয়ন্ত সিনহাকে। কিন্তু তাতেও ফল হয়নি। সদ্য গত মাসেই তিনি নিজের বাড়িতে ব্যাঙ্কের কর্তাদের আমন্ত্রণ জানান। এমন এক দিনে, যেদিন তাঁর ‘বস’ অরুণ জেটলি সমস্ত ব্যাঙ্কের প্রধানের সঙ্গে বৈঠক করেন। আর সেই আসরে ছিলেন জয়ন্তের স্ত্রী পুনিতাও। জয়ন্ত সিনহা অর্থ দফতরের প্রতিমন্ত্রী থাকার সময় যাঁকে ইনফোসিসের নির্দেশক করা নিয়ে বিতর্ক হয়। প্রশ্ন ওঠে, ‘স্বার্থের আঘাত’ নিয়েও। বিজেপির এক নেতা আজ বলেন, ‘‘প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী যশবন্ত সিনহার পুত্র জয়ন্তকে মন্ত্রী করার পর তাঁর যেখানে আরও সংযমী ও সতর্ক থাকা উচিত ছিল, সেটি না করে তিনি এমন সব পদক্ষেপ করতে শুরু করলেন যাতে অরুণ জেটলি থেকে নরেন্দ্র মোদীর উষ্মার কারণ ঘটতে থাকে। এই যশবন্ত সিনহাই সদ্য কিছু দিন আগেও দলের প্রবীণ নেতা লালকৃষ্ণ আডবাণী, মুরলীমনোহর জোশীদের সঙ্গে জোট বেঁধে নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন। ফলে সেগুলি আদৌ ভাল লাগার কথা নয় প্রধানমন্ত্রীর।’’
তবে বিজেপি সূত্রের মতে, এটা ঠিক, জয়ন্ত সিনহার থেকে স্মৃতি ইরানি প্রধানমন্ত্রীর অনেক প্রিয়পাত্র। স্মৃতিকে নিয়ে বিতর্কের জেরে তাঁকে মন্ত্রক থেকে সরাতে হয়েছে বটে, কিন্তু তাঁকে অন্য ভাবে কাজে লাগানো হতে পারে। কিন্তু জয়ন্তর ক্ষেত্রে বিষয়টি অন্য। পারিবারিক ভাবেই জয়ন্ত প্রধানমন্ত্রীর ‘কাছের লোক’ নন। ফলে বেঙ্কাইয়া নায়ডুকে তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রক দিয়ে কিংবা অনন্ত কুমারের গুরুত্ব বাড়িয়ে অথবা সুষমা স্বরাজ-ঘনিষ্ঠ সুরিন্দর সিংহ অহলুওয়ালিয়াকে মন্ত্রিসভায় এনে জেটলির অস্বস্তি বাড়ালেও অন্তত অর্থমন্ত্রক থেকে জয়ন্ত সিনহাকে সরিয়ে অর্থমন্ত্রীকে স্বস্তি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
কিন্তু নর্থ ব্লক থেকে বিদায়ের সময়েও জয়ন্তর আচরণে খুশি নন সরকারের অনেকেই। গতকাল অর্থমন্ত্রকের নতুন দুই প্রতিমন্ত্রী সন্তোষ গাঙ্গোয়ার আর অর্জুন মেঘওয়ালের দায়িত্ব গ্রহণের সময় নর্থ ব্লকে জেটলির ঘরে জয়ন্তও এসেছিলেন। একসঙ্গে কফিও খেয়েছেন। কিন্তু নতুন প্রতিমন্ত্রীদের নিজের ঘরে দায়িত্ব নেওয়ার সময় ‘অখুশি’ জয়ন্ত চলে যান দফতর ছেড়ে। পরে নতুন মন্ত্রকের ভার অবশ্য নিয়েছেন। কিন্তু জেটলির ঘর থেকে প্রতিমন্ত্রীদের ঘরে হেঁটে যেতে রাজি হননি। খোদ জেটলি নতুন প্রতিমন্ত্রীদের নিয়ে তাঁদের ঘরে নিয়ে যান। জেটলি অবশ্য এই ঘটনাকে লঘু করে বলার চেষ্টা করেন, ‘‘জয়ন্ত আমার ঘরে বসে কফি খেয়েছেন। তার পর বোধহয় তাঁর অন্যত্র যাওয়ার ছিল, তাই বেরিয়ে গিয়েছেন।’’