এমনই সব স্লোগান লেখা হয়েছিল মথুরার দেওয়ালে দেওয়ালে। —নিজস্ব চিত্র।
তিনি নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর এক স্বঘোষিত অনুগামী। তিনি মথুরার জওহর বাগকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন !
নিজস্ব সেনাবাহিনী তৈরি করেছিলেন তিনি। বাহিনীর নাম দিয়েছিলেন আজাদ হিন্দ ফৌজ!
সেই ফৌজের হাতেই শুক্রবার খুন হয়ে গেলেন মথুরার পুলিশ সুপার মুকুল দ্বিবেদী। ভয়ঙ্কর লড়াইতে প্রাণ গেল অন্তত ২৪ জনের। জখম হলেন প্রায় ১০০ জন।
এই সব কিছুর মূলে যিনি, তিনি প্রায় হাজার খানেক অনুগামী সহ তিনি এখন গায়েব।
তিনি হলেন রামবৃক্ষ যাদব। মথুরায় ধুন্ধুমার ঘটে যাওয়ার পর নানা অদ্ভুত এবং চমকে দেওয়ার মতো তথ্য উঠে আসছে রামবৃক্ষ যাদব সম্পর্কে।
উত্তরপ্রদেশের পূর্বাঞ্চলে গাজিপুরে আসল বাড়ি রামবৃক্ষ যাদবের। সেখানে নানা রকম অসামাজিক কার্যকলাপের অভিযোগে এলাকাছাড়া হন। মথুরায় গিয়ে দুধের ব্যবসা শুরু করেন। কিন্তু অল্প দিনের মধ্যেই ব্যবসা লাটে ওঠে। তখন রামবৃক্ষ সপরিবার আশ্রয় নেন স্বঘোষিত ধর্মগুরু তুলসীদাস যাদব ওরফে জয় গুরুদেবজির আশ্রমে। দ্রুত তুলসীদাসের প্রিয়পাত্র হয়ে উঠেছিলেন তিনি। কিন্তু ২০১০ সালে রামবৃক্ষের উপর অসন্তুষ্ট হয়ে তাঁকে আশ্রম থেকে বার করে দেন তুলসীদাস। পরে অবশ্য আবার ফিরিয়েও নেন।
তুলসীদাস যাদব ওরফে জয় গুরুদেবজির মৃত্যুর পর ঘটনা অন্য দিকে মোড় নেয়। এই তুলসীদাস যাদব নিজেকে নেতাজির অবতার বলে দাবি করতেন। তাঁর মৃত্যুর পর রামবৃক্ষের অনুগামীরা বলতে শুরু করেন, জয় গুরুদেবজির আত্মা রামবৃক্ষ যাদবের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। তাই আশ্রমের প্রধান হবেন রামবৃক্ষ। অর্থাৎ রামবৃক্ষই এখন নেতাজির অবতার। কিন্তু রামবৃক্ষের বিরোধীর সংখ্যাও আশ্রমে কম ছিল না। তাঁরা রামবৃক্ষের উদ্দেশ্য আঁচ করে আশ্রম থেকে তাঁকে বার করে দেন। এর পরই স্বাধীন ভারত বৈদিক সত্যাগ্রহ নামে সংগঠন তৈরি করেন রামবৃক্ষ যাদব।
সংগঠনের নাম নিয়ে অবশ্য মতান্তর রয়েছে। কখনও রামবৃক্ষ বলতেন তাঁর সংগঠনের নাম স্বাধীন ভারত বৈদিক সত্যাগ্রহ, কখনও বলতেন সংগঠনের নাম স্বাধীন ভারত সুভাষ সেনা, কখনও বলতেন ভারতীয় সুভাষ সেনা। নিজেকে সুভাষচন্দ্র বসুর অনুগামী বলে দাবি করতেন এবং বলতেন নেতাজির অসমাপ্ত কাজ তিনিই শেষ করবেন।
সংগঠনের নাম বা কার্যকলাপ যা-ই হোক, রামবৃক্ষ যাদবের প্রভাব ক্রমশ বাড়ছিল। কারণ সমাজবাদী পার্টির সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা দীর্ঘ দিনের। আর যে সময় আশ্রম থেকে বহিষ্কৃত হয়ে তিনি নিজের সংগঠন তৈরি করেছিলেন, তখনই উত্তরপ্রদেশে ক্ষমতায় আসে মুলায়ম সিংহ যাদবের সমাজবাদী পার্টি। মুলায়মের ভাই তথা রাজ্যের পূর্ত মন্ত্রী শিবপাল সিংহ যাদবের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সুবাদে মথুরায় বাড়তে থাকে রামবৃক্ষের প্রতিপত্তি। ২০১৪ সালের ১ জানুয়ারি রামবৃক্ষ যাদব অবস্থান ধর্মঘটের নাম করে ৩০০ একর জুড়ে ছড়িয়ে থাকা জওহর বাগ পার্কে ঢুকেছিলেন। তাঁর আসল উদ্দেশ্য যে অন্য কিছু ছিল, তা এত দিন পরে বোঝা গিয়েছে। দু’দিনের জন্য অবস্থান ধর্মঘটের অনুমতি নিয়ে পার্কে ঢুকে গত আড়াই বছর ধরে ৩০০ একরের ওই বিশাল এলাকা জবরদখল করে রেখেছিলেন রামবৃক্ষ যাদবের অনুগামীরা।
ঠিক কী চলছিল ওই পার্কে? জানা গিয়েছে, রামবৃক্ষ যাদব ৩০০ একরের পার্ককে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। তাঁবু এবং অস্থায়ী বাসস্থান বানিয়ে পার্কের মধ্যেই নিজের সব অনুগামীর থাকার ব্যবস্থা করেছিলেন রামবৃক্ষ। তবে স্বাধীন রাষ্ট্রের অধীশ্বর হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে হলে তো শুধু অনুগামীদের বা ‘রাষ্ট্রের নাগরিক’দের থাকার ব্যবস্থা করলেই হয় না। প্রশাসন থাকতে হয়, সেনাবাহিনী থাকতে হয়। সে সবেরও ব্যবস্থা করেছিলেন রামবৃক্ষ। সেনাবাহিনীর নাম দিয়েছিলেন আজাদ হিন্দ ফৌজ। সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ করেছিলেন এক চন্দন বসু নামে বাঙালিকে। এই চন্দন বসুর আসল বাড়ি শিলিগুড়িতে। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর আজাদ হিন্দ ফৌজের সঙ্গে নিজের ফৌজের সাদৃশ্য তুলে ধরতেই নাকি বসু পদবীধারী এক বাঙালিকে তিনি সেনাপ্রধান করেছিলেন।
আরও পড়ুন:
যুদ্ধের পর শান্ত মথুরা, হাসি ফুটল প্রতিবেশীদের মুখে
জওহর পার্কের ‘স্বাধীন রাষ্ট্রে’ ক্রমশ বাড়ছিল জনসংখ্যা। উত্তরপ্রদেশের বিভিন্ন জেলা থেকে, এমনকী ভিনরাজ্য থেকেও লোকজন জোগাড় করে অনুগামীর সংখ্যা বাড়াচ্ছিলেন রামবৃক্ষ। নতুন ‘নাগরিক’দের জন্য দ্রুত তৈরি হচ্ছিল তাঁবু বা বাসস্থান। আজাদ হিন্দ পৌজের জন্য বদাউন থেকে আমদানি করা হচ্ছিল প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র এবং গোলা-বারুদ।
প্রশাসনের কাছে যে এ সব খবর ছিল না তা নয়। গোয়েন্দা রিপোর্টে জওহর পার্কের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছিল। পুলিশ-প্রশাসন জওহর পার্কে অভিযান চালাতে গিয়ে এক বার বড়সড় হামলার মুখেও পড়েছিল। কিন্তু জবরদখলকারীদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি। কারণ লখনউ থেকে প্রভাবশালী কোনও মন্ত্রী ফোন করে বারণ করেছিলেন। উত্তরপ্রদেশ পুলিশের এক পদস্থ কর্তাই জানিয়েছেন, যত বার জবরদখলকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টা হয়েছে, তত বারই লখনউ থেকে ফোন এসেছে— ‘ধীরে চলো’।
লখনউ যতই স্বস্তি দিক, ইলাহাবাদ কিন্তু রামবৃক্ষের অস্বস্তি ক্রমশ বাড়াচ্ছিল। ইলাহাবাদ হাইকোর্ট মথুরার প্রশাসনকে নির্দেশ দিয়েছিল, জওহর বাগের পার্ক খালি করতে। প্রথম বার সে নির্দেশে খুব একটা সাড়া দেয়নি পুলিশ। তাতে হাইকোর্ট কড়া ধমক দেয় পুলিশকে, অবিলম্বে পার্ক কালি করানোর জন্য জেলা প্রশাসনকে নির্দেশ দেওয়া হয়।
সেই নির্দেশ পালন করতেই শুক্রবার জওহর বাগের পার্কে হানা দেয় পুলিশ। নেতৃত্বে ছিলেন পুলিশ সুপার স্বয়ং। কিন্তু রামবৃক্ষ যাদবে আজাদ হিন্দ ফৌজের সৈনিকরা বিভিন্ন গাছের মাথায় পজিশন নিয়ে অপেক্ষায় ছিল। নিজেদের ‘স্বাধীন রাষ্ট্র’কে রক্ষা করতে পুলিশকে লক্ষ্য করে অটোম্যাটিক রাইফেল থেকে গুলি চালানো শুরু হয়। কখনও গ্রেনেড হামলা হয়, কখনও গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। পুলিশ সুপার-সহ দুই পুলিশ কর্মীর মৃত্যু হয়। ভয়ঙ্কর গোলাগুলি আর বিস্ফোরণে মৃত্যু হয় আরও ২২ জনের। প্রায় ১০০ জনের কাছাকাছি জখম হন। প্রতিরোধ ভেঙে পার্কে ঢুকে ৩২০ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। উদ্ধার হয়েছে ৪৭টি পিস্তল, ৫টি রাইফেল এবং ১৬০টি কার্তুজ। ৩২০টি খালি কার্তুজের খোলও মিলেছে। অর্থাৎ পুলিশকে লক্ষ্য করে অন্তত ৩২০ রাউন্ড গুলি চালিয়েছিল রামবৃক্ষের সেনাবাহিনী।
রামবৃক্ষ এখনও অধরা। অধরা তাঁর সেনাপ্রধান চন্দন বসুও। এক হাজারের বেশি অনুগামীকে নিয়ে নিয়ে বেপাত্তা হয়ে গিয়েছেন সংঘর্ষ চলাকালীন। অখিলেশ যাদবের সরকার অবশ্য বলছে, রামবৃক্ষ-চন্দন পার পাবেন না।