National News

আগুন জ্বলছে দিল্লিতে, মৃত্যু ৪ জনের

ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভারত সফরের প্রথম দিনে পাথরবৃষ্টি থেকে গুলি, দোকানে-বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া— সব কিছুরই সাক্ষী হল রাজধানী দিল্লি।

Advertisement

প্রেমাংশু চৌধুরী

নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ০৩:৪২
Share:

রণক্ষেত্র: পিস্তল উঁচিয়ে উত্তর-পূর্ব দিল্লির রাস্তায়। সোমবার। ছবি: পিটিআই।

‘‘এখান থেকে গাড়ি সরিয়ে নিন। যে কোনও সময় আগুন জ্বলবে।’’

Advertisement

কানের কাছে মুখ এনে পরামর্শ দিলেন বৃদ্ধ। বেলা একটা। উত্তর-পূর্ব দিল্লির জাফরাবাদ মেট্রো স্টেশন। ইন্ডিয়া গেট থেকে মেরেকেটে ১৫ কিলোমিটার।

মেট্রো স্টেশনের নীচেই বোরখা পরা মহিলারা সিএএ-এনআরসি-র বিরুদ্ধে ধর্নায় বসেছেন। দু’কিমি দূরে মৌজপুর-বাবরপুর মেট্রো স্টেশনের কাছে ভিড়ের মধ্যে আবার সিএএ-র পক্ষে স্লোগান উঠছে। একটু পরে পরেই শোনা যাচ্ছে, ‘এক হি নারা, এক হি নাম, জয় শ্রীরাম, জয় শ্রীরাম’। উড়ছে গেরুয়া পতাকা। রায়ট-গিয়ারে পুলিশ থিকথিক করছে গোটা এলাকায়। রাস্তার একপাশে সারি দিয়ে পুলিশের ভ্যান। শুধুই খাকি উর্দির পুলিশ।

Advertisement

এখানে আগুন জ্বলবে? এই ভরদুপুরেই?

শুধু আগুন নয়। ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভারত সফরের প্রথম দিনে পাথরবৃষ্টি থেকে গুলি, দোকানে-বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া— সব কিছুরই সাক্ষী হল রাজধানী দিল্লি। সিএএ-বিরোধী আন্দোলন ঘিরে অশান্তিকে কেন্দ্র করে এই প্রথম দিল্লিতে চার জন প্রাণ হারালেন। মৌজপুরে পাথরের আঘাতে পুলিশের হেড কনস্টেবল রতন লালের মৃত্যু হয়। এর পর বিকেলে চাঁদবাগে ফুরকান আনসারি (৩২) নামে এক ব্যক্তি নিহত হন। রাতে গুরু তেগবাহাদুর হাসপাতালে মারা যান শাহিদ নামে এক যুবক। অজ্ঞাতপরিচয় আরও এক জনের মৃত্যুর খবর দিয়েছে সংবাদ সংস্থা পিটিআই। সূত্রের খবর, আহত হয়ে তেগবাহাদুর হাসপাতালেই ভর্তি অন্তত ২০ জন।

প্রতিবাদীকে মাটিতে ফেলে গণপিটুনি সিএএ-সমর্থকদের। সোমবার নয়াদিল্লিতে। ছবি: রয়টার্স।

জাফরাবাদের বৃদ্ধ অচেনা সাংবাদিককে সাবধান করে গাড়ি সরিয়ে নিয়ে বলেছিলেন। কিন্তু দুপুরে জাফরাবাদেই চারটে দোকান ও বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে। তিনটে গাড়িও জ্বালানো হয়েছে। গাড়ি সরিয়ে নিয়ে যেতে না-যেতেই শুরু হয়েছে পাথরবৃষ্টি। ভিড়ের মধ্যে থেকে পাথর গিয়ে পড়েছে রাস্তার ধারের বাড়ির দোতলার ব্যালকনিতে। ‘ভারত মাতা কি জয়’ বলে উল্লাসে ফেটে পড়েছে জনতা। পেট্রল-বোমা হাতে হাতে ঘুরেছে। ভিড়ের মধ্যে শুধু একটাই প্রশ্ন, ‘মাচিস কাঁহা হ্যায়?’ জাফরাবাদ মসজিদের পাশের গলিতে এক যুবককে চেপে ধরে বেদম পেটানো হয়েছে। এক দিকে সিএএ-বিরোধীরা। অন্য দিকে সিএএ-পন্থীরা। বোঝা মুশকিল, কে কোন দিকে!

দুই শিবিরের খণ্ডযুদ্ধের মধ্যে মৌজপুরে গোকুলপুরীর হেড কনস্টেবল রতন লালের মাথায় পাথর এসে পড়ে। তাঁকে নিয়ে পুলিশের জিপ হাসপাতালে ছোটে। কিন্তু রতন লালকে বাঁচানো যায়নি।

সোমবার নয়াদিল্লির ভজনপুরা এলাকায় বিক্ষোভ-সংঘর্ষ। ছবি: এএফপি।

দিল্লি পুলিশের ডিসি (শাহদরা) অমিত শর্মা পাথরের আঘাতে আহত হন। ভজনপুরায় একটি পেট্রল পাম্পে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। চাঁদবাগে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ছোড়ে।

মৌজপুরে এক পুলিশ-কর্মীর সামনেই দেশি পিস্তল উঁচিয়ে তেড়ে আসে লাল টি-শার্ট এক যুবক। বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট পরা পুলিশ-কর্মী পরা তাকে শান্ত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু পুলিশকে হটাতে প্রথমে আকাশে, তার পরে রাস্তার ধারের ভিড় লক্ষ্য করে পরপর আট রাউন্ড গুলি ছোড়ে সে। সন্ধ্যায় পুলিশ জানায়, শাহরুখ নামে ওই যুবককে গ্রেফতার করা হয়েছে।

নিহত: হেড কনস্টেবল রতন লাল।

রবিবার বিকেল থেকে সোমবার সন্ধ্যা পর্যন্ত অশান্তির জেরে জাফরাবাদ অঞ্চলের বহু মুসলিম পরিবার ঘরে তালা ঝুলিয়ে মহল্লা ছেড়েছেন। জাফরাবাদ, মৌজপুর, বাবরপুর, সিলমপুরের অনেকে বাড়ির সামনে গেরুয়া পতাকা ঝুলিয়ে দিয়েছেন, যাতে হামলা না হয়। ২০০২-এ গুজরাত দাঙ্গার সময় আমদাবাদেও এই দৃশ্য দেখা গিয়েছিল। জাফরাবাদ, মৌজপুর-বাবরপুর তো বটেই, তার সঙ্গে আরও তিনটি মেট্রো স্টেশন বন্ধ করে ওই লাইনে মেট্রো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। জারি হয়েছে ১৪৪ ধারা। মঙ্গলবার পূর্ব ও উত্তর-পূর্ব দিল্লির সমস্ত স্কুল বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছে প্রশাসন।

এরই মধ্যে রাতে আগুন লাগানো হয় গোকুলপুরীর টায়ার বাজারের একের পর এক দোকানে। দিল্লির আপ সরকারের তিন মন্ত্রী এবং বহু বিধায়ক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ জানাতে এবং পুলিশি সক্রিয়তার দাবি নিয়ে বেশি রাতে উপরাজ্যপালের বাড়ির সামনে ধর্না দেন। দিল্লির আইন-শৃঙ্খলার ভার অমিত শাহের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের। বিকেলে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রসচিব অজয় ভাল্লা বলেছিলেন, ‘‘পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে। যথেষ্ট বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে।’’ মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরীবাল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও উপরাজ্যপালের কাছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার আর্জি জানিয়েছিলেন। সনিয়া গাঁধী, রাহুল গাঁধী, প্রিয়ঙ্কাও শান্তির আহ্বান জানান। রতন লালের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেন সনিয়া। মোদীর গাঁধী-প্রেমকে খোঁচা দিয়ে বলেন, ‘মহাত্মার ভারতে হিংসার কোনও স্থান নেই’। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক তথা দিল্লি পুলিশের কর্তারা মনে করছেন, ট্রাম্পের সফরের দিকে নজর রেখেই সিএএ-বিরোধীরা অশান্তি তৈরির চেষ্টা করেছেন। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী জি কিষেণ রেড্ডি বলেন, ‘‘মার্কিন প্রেসিডেন্টের সফরের সময় ভারতের ভাবমূর্তি নষ্ট করার চেষ্টা হচ্ছে।’’

কথাটা পুরোপুরি অস্বীকার করছেন না জাফরাবাদের বাসিন্দারা। কিন্তু অশান্তির জন্য তাঁদের অভিযোগের আঙুল বিজেপি নেতা কপিল মিশ্রের দিকে। জাফরাবাদের বাসিন্দা খালিদ আখতার বলেন, ‘‘এখানে গত দু’মাস ধরে রাস্তার ধারের মাঠে মহিলারা সিএএ-এনআরসি-র বিরুদ্ধে ধর্নায় বসেছিলেন। কেউ তাঁদের সঙ্গে কথা বলতে আসেনি। আমরা রাস্তা অবরোধ করিনি। তাই কেউ মাথায় ঘামায়নি।’’

এই ক্ষোভ থেকেই শনিবার রাস্তার এক দিক অবরোধ করে মহিলারা ধর্নায় বসেন। রবিবার দুপুরে মৌজপুরে হাজির হন কপিল মিশ্র। তিন দিনের মধ্যে সিএএ-বিরোধীদের তুলে দেওয়ার জন্য পুলিশকে হুঁশিয়ারি দেন। তার পরেই পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে। রবিবার প্রায় মাঝরাতে দুই ট্রাক ভর্তি ইট-পাথর রাস্তায় নামিয়ে দেওয়া হয়। আখতারের প্রশ্ন, ‘‘কারা পাথরের জোগান দিয়ে গেল? কারা এখানে দাঙ্গা লাগাতে চাইছে?’’

কপিল মিশ্র আজ বলেন, ‘‘শান্তিতেই সকলের মঙ্গল। এই হিংসা মেনে নেওয়া যায় না।’’ কিন্তু সিএএ-বিরোধীরাই প্রথমে পাথর ছুড়েছেন বলে তাঁর অভিযোগ।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement