প্রতীকী ছবি।
‘ভূমিপুত্রের ভরসায় আত্মনির্ভর আমেরিকা!’ ভোটের মুখে দাঁড়িয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের এই ঘোষণায় প্রবল দুশ্চিন্তায় ভারতের তথ্যপ্রযুক্তি শিল্প।
অভিবাসন আর বিদেশি কর্মী নিয়োগ ছাঁটাইকে পাখির চোখ করা ট্রাম্প অনেক দিন থেকেই বলছিলেন, এইচ-১বি, এল-১ এর মতো ভিসায় নতুন কর্মী আসার স্রোত আটকানোর কথা। এ দেশের তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের বড় অংশ মনে করছে, করোনায় কোণঠাসা অবস্থায় এবং আমেরিকায় চড়া বেকারত্বের ‘সুযোগে’ ভোটের মুখে সেই কাজ সেরে ফেললেন তিনি।
বিশ্ব অর্থনীতি টালমাটাল। নতুন কাজের বরাত নগণ্য। অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো তথ্যপ্রযুক্তি-বাজেটও কাটছাঁট করছে অধিকাংশ সংস্থা। এই পরিস্থিতিতে ট্রাম্পের ঘোষণা তাই এ দেশের তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, ঘুম কেড়ে নিচ্ছে সফ্টওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার-সহ ওই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত বহু কর্মীর। মার্কিন প্রেসিডেন্টের দাবি, সে দেশে বেকারত্ব চরমে। তাই অন্তত এ বছরের শেষ পর্যন্ত নতুন করে আর দেওয়া হবে না চার ভিসা। এইচ-১বি, এল, এইচ-২বি এবং জে। ওই ভিসায় ভর করে যাঁরা এই মুহূর্তে আমেরিকায় কাজ করছেন, তাঁদের যেতে বলা হবে না ঠিকই। কিন্তু নতুন করে আসতেও পারবেন না কোনও ভিন্দেশি কর্মী।
আরও পড়ুন: ভোটে জিততেই কি ভিসায় কোপ ট্রাম্পের
ভারতের চিন্তা এখানেই। কারণ, ফি-বছর যত এইচ-১বি ভিসা দেওয়া হয়, তার অন্তত ৭০% থাকে ভারতীয়দের পকেটে। মূলত তার জোরেই বিভিন্ন সংস্থার প্রকল্পে কর্মী পাঠায় টিসিএস, কগনিজ্যান্ট, উইপ্রোর মতো সংস্থা। এল-১ ভিসার ভরসায় ভারত থেকে কর্মীদের বদলি করে আমেরিকায় কাজে নিয়ে যায় সে দেশের মাটিতে ব্যবসা করা বিভিন্ন সংস্থা। এখন দুই ভিসাই বন্ধ থাকা তাদের পক্ষে চিন্তার। চিন্তিত ডাক্তার, হিসাবরক্ষক, অধ্যাপক, গবেষক-সহ কিছু দিন আমেরিকায় কাজ করতে পা-বাড়ানো অন্য পেশাদারেরাও।
ভারতের মাথাব্যথা
• এইচ-১বি এবং এল ভিসা বাতিল সব থেকে বেশি চিন্তার। বিশেষত তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের।
• বরাত পাওয়া কাজে কর্মী পাঠাতে এইচ-১বি সব চেয়ে বেশি ব্যবহার করে টিসিএস, ইনফোসিস, কগনিজ্যান্টের মতো সংস্থা।
• এ দেশ থেকে কর্মী নিতে ওই দুই ভিসা ব্যবহার করে অ্যামাজ়ন, গুগল, মাইক্রোসফট, ফেসবুকও।
• বছরে ৮৫ হাজার এইচ-১বি ভিসার অন্তত ৭০% থাকে ভারতীয়দের পকেটে।
ভারতের তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থাগুলির সংগঠন ন্যাসকমের আর্জি, ৬ মাসের বদলে এই বিধিনিষেধ আরোপ করা হোক ৩ মাসের (৯০ দিন) জন্য। দাবি, তারা ছাড়াও এমন পদক্ষেপের বিরোধী মার্কিন বণিকসভা ইউএস চেম্বার অব কমার্স, আমেরিকান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন, কম্পিট আমেরিকা, ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব ম্যানুফ্যাকচারার্সের মতো সংগঠন। ন্যাসকমের প্রেসিডেন্ট দেবযানী ঘোষের মতে, এই পদক্ষেপ আমেরিকার অর্থনীতির জন্যই নেতিবাচক। বিশেষত যখন তা ঘুরে দাঁড়াতে চাইছে। কারণ, উদ্ভাবন ও মেধার ঘাটতি নিয়ে সেটা করা কঠিন।
গুগলের মূল সংস্থা অ্যালফাবেটের সিইও সুন্দর পিচাইয়ের টুইট, “মার্কিন অর্থনীতির সাফল্যের পিছনে বড় ভূমিকা ভিন্ দেশি কর্মীদের। এই দেশকে প্রযুক্তির প্রথম সারিতে নিয়ে আসার পিছনেও অনেক অবদান তাঁদের।…আজকের এই ঘোষণায় (আমি) হতাশ।” যদিও ‘সকলকে’ কাজ দেওয়ার বিষয়ে গুগল দায়বদ্ধ থাকবে বলেই তাঁর দাবি।
আরও পড়ুন: ভারতীয়দের ফেরাতে লাগবে আগাম অনুমতি, জানাল ট্রাম্প প্রশাসন
এ দেশের তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের একাংশ বলছে, এই শিল্পে ইংরেজি জানা ও বলা দক্ষ কর্মী সস্তায় পেতে ভারতকে উপেক্ষা করা শক্ত। তাই আগামী দিনে এই ঘোষণার বিরোধিতা বাড়বে। কিন্তু তেমনই আর এক অংশের বক্তব্য, বছর দশেক আগেও এ দেশের তথ্যপ্রযুক্তি পেশাদারদের বিশ্ব বাজারে যে আকাশছোঁয়া চাহিদা ছিল, এখন তা অনেকটাই ফিকে রোবোটিক্স, আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স, মেশিন লার্নিংয়ের মতো কাজখেকো প্রযুক্তির জেরে। বিশ্ব বাজারে চাহিদা নড়বড়ে ২০০৮ সালের মন্দার পর থেকেও। এই সবের উপরে করোনার কঠিন সময়ে এই নিষেধাজ্ঞা তাই চিন্তায় ফেলার মতো।
তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের এক কর্মী আক্ষেপ করে বলেন, “লাদাখ সীমান্তে চোখ রাঙাচ্ছে নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে দোলনায় দোলা শি চিনফিংয়ের চিন। আর যে ট্রাম্পের সঙ্গে এত সখ্য, এখন তাঁরও ধোঁকা দেওয়ার পালা। আমেরিকার হিউস্টনে ‘হাউডি মোদী’, করোনা মাথায় নিয়েও আমদাবাদে ‘কেমছো ট্রাম্প’, সব তা হলে জলে?”
মোদী সরকার অবশ্য এখনও সরকারি ভাবে ট্রাম্পের সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানায়নি। তবে বিষয়টিকে ভারত-মার্কিন সম্পর্কের ক্ষেত্রে বড় ধাক্কা বলেই মনে করছেন বিদেশ মন্ত্রকের আধিকারিকেরা। কারণ, দু’সপ্তাহ আগেই বিদেশসচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলা আমেরিকার উদ্দেশে বলেছিলেন, সে দেশে বসবাসকারী ভারতীয় পেশাদারেরা অতিমারির সময়ে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, গবেষণার ক্ষেত্রে লড়াই করছেন। ভিসার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে আমেরিকা যেন বিষয়টি মাথায় রাখে।
নয়াদিল্লিতে সরকারি সূত্রের বক্তব্য, ভিসা-জটিলতা কাটানোর চেষ্টা চলবে। তবে স্বস্তির কথা, করোনা পরিস্থিতিতে আমেরিকা কম ভিসা দিচ্ছে। এমনিতে ছ’মাসে ৪৫ হাজার এইচ-১বি ভিসা দেয় তারা। সেই হিসেবে এই কয়েক মাসে ৩০ হাজার ভিসা আসত। কিন্তু যে হেতু কম ভিসা দিচ্ছে তারা, তাই খুব বেশি হলে এই সময়ের মধ্যে ৫ থেকে ১০ হাজার ভিসা আসত। আমেরিকায় এমনিতেই ৩ লক্ষ এইচ-১বি ভিসাধারী রয়েছেন।