আবার টেনে আনতে হচ্ছে সেই পুরনো প্রবাদ— ‘আপনি আচরি ধর্ম পরেরে শিখাও’।
সংসদ আইন তৈরি করে। পথ দেখায় গোটা দেশকে। নোট বাতিলের অভিযানে সরকার যখন প্লাস্টিক মানি (কার্ডের মাধ্যমে লেনদেন) ব্যবহারে জোর দিচ্ছে, নগদের পরিবর্তে আমজনতার লেনদেনকে নিয়ে আসতে চলেছে ব্যাঙ্ক-আয়কর দফতরের নজরদারির আওতায়, তখন গোটা সংসদ ভবন কিন্তু পড়ে রয়েছে প্রস্তর যুগে। ক্যান্টিন বা সেন্ট্রাল হলের সাংসদ-সাংবাদিকদের চা-টোস্টের বৈঠকী আড্ডা, কফি-টি বোর্ডের স্টলে বিক্রিবাটা— এখানে সবই চলে নগদে! এখনও। ‘প্লাস্টিক মানি’ এখানে আজও ব্রাত্য।
পাঁচশো-হাজারের নোট বাতিলের জেরে এমনিতেই খুচরোর আকাল দেশ জুড়ে। যার আঁচে গরম সংসদও। গত কালই দলীয় সাংসদদের সঙ্গে সেন্ট্রাল হলে দুপুরের খাওয়া সেরেছিলেন এনসিপি নেতা শরদ পওয়ার। বেয়ারার কাছে ছ’শো টাকা বিল হয়েছে শুনেই মুখটা অন্য দিকে ঘুরিয়ে নেন। নিন্দুকেরা বলছেন, এর অর্থ একটাই— ‘এখন টাকা নেই। পরে এসো বাবা।’ আর বেয়ারাদের টিপস্? সে সব অতীত। রীতিমতো পকেট মেপে খরচ করছেন সাংসদেরাও। কারণ পকেটে টাকা বাড়ন্ত।
আসলে সাংসদদের মানিব্যাগের হালও যে এখন মুদি দোকানে বা মাছের বাজারে ধার করা গড়পড়তা আম আদমির মতোই, তা গত কালই বিলক্ষণ বুঝেছেন বেশ কিছু সাংবাদিক। দুপুরে লোকসভার অধিবেশন মুলতুবি হওয়ার পরে জনাকয়েক সাংবাদিককে সংসদ ক্যান্টিনে খেতে নিয়ে গিয়েছিলেন বিজেপির এক সাংসদ। খাওয়ার পরে দেখা যায়, সাংসদের পকেটে নোট বাড়ন্ত। কার্ডের মাধ্যমে বিল দিতে গিয়ে আরও চমকে ওঠেন ওই সাংসদ। ক্যান্টিন জানায়, কার্ডে ‘পেমেন্ট’ নেওয়ার কোনও ব্যবস্থাই তাদের নেই। অগত্যা লজ্জার মাথা খেয়ে, চেয়ে-চিন্তে কোনও ভাবে বিল চোকান ওই সাংসদ। যাওয়ার সময় ক্ষুব্ধ সাংসদ গোটা বিষয়টি কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলির কাছে নালিশ করবেন বলেও জানিয়ে যান।
বেজায় মুশকিলে পড়েছে সংসদ ক্যান্টিনের দায়িত্বে থাকা উত্তর রেলওয়ে। এত দিন দিব্যি পাঁচশো-হাজারের নোটে কাজ চলত। দু’-দশ টাকা উপরি আয়ও হতো বেয়ারাদের। কিন্তু এমনও যে ঘটতে পারে, কে ভেবেছিল? বরং ক্যান্টিনে খেতে গিয়ে অনেকেই এখন রাগ করে বলছেন, সংসদ ভবনের মতো জায়গায় এই ধরনের লেনদেনের ক্ষেত্রে বিকল্প বন্দোবস্তগুলো এত দিন চালু হয়নি কেন? এখন পানের দোকানে পর্যন্ত মোবাইলে টাকা মেটানো যায়। সংসদে তা তো দূরের কথা, কার্ড সোয়াইপের ব্যবস্থাটুকুও নেই!
শুধু কি সংসদ? ঢিল ছুড়লেই রেল ভবন। কর্মী সংখ্যার দিক থেকে দেশের সবথেকে বড় সরকারি প্রতিষ্ঠান। যে রেল ফি-দিন ইন্টারনেটে টিকিট বিক্রি বাড়ছে বলে দাবি করে, তাদেরই তিনতলার ক্যান্টিনে লেনদেনে ভরসা শুধু নগদ নারায়ণেই। রেল মন্ত্রক জানাচ্ছে, গত দশ দিনে বহু কর্মীই খাবারের টাকা দিতে পারেননি। তা বলে তো ক্যান্টিন বন্ধ করে দেওয়া যায় না। তাই ধারের খাতায় হিসেব রাখা হচ্ছে।
কিন্তু সমস্যা মিটবে কী ভাবে?
সরকারি সূত্রের বক্তব্য, সংসদ-সহ রেলের ক্যান্টিনে অবিলম্বে কার্ড সোয়াইপ মেশিন বসানোর জন্য ব্যাঙ্কগুলির সঙ্গে কথাবার্তা শুরু হয়েছে। চলতি অধিবেশনেই সংসদে এই পরিষেবা চালু করা যাবে বলে আশাবাদী উত্তর রেলওয়ে। একই সমস্যায় ভুগছে কৃষি ভবন বা শাস্ত্রী ভবনের সরকারি ক্যান্টিনগুলি।
ধাপে ধাপে সেখানেও মেশিন বসানোর দাবি উঠেছে।
আজ সকালে লোকসভায় মোদী সরকারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ শানিয়েছেন তৃণমূল সাংসদ কাকলি ঘোষ দস্তিদার। অধিবেশন মুলতুবি হতেই সংসদের দোতলায় সাংসদের জন্য নির্দিষ্ট ব্যাঙ্কে দেখা গেল তাঁকে। নিজের সংসদীয় অ্যাকাউন্ট থেকে দু’টো একশো টাকার দু’বাণ্ডিল তুলে বাঙালি সাংবাদিকদের কাকলি বললেন, ‘‘খুচরোর যা অভাব! বড় নোট দিয়ে বাজারে যাওয়াই মুশকিল হয়ে পড়েছে। তাই একশোই ভরসা!’’