—দীপিকা পাড়ুকোন।
আমার কোনও যোগ্যতা নেই, কিছু নেই। অপদার্থ, নিজের ওপর এক রাশ রাগ আর ঘেন্না ছাড়া আর কিছুই নেই। কিন্তু নিজেকে ঘৃণা করা এই করুণ মুখ তো দুনিয়ার সামনে দেখানো যায় না। মনোজগৎ সেটাকে অন্য ভাবে ঘুরিয়ে দেয়। নিজে বাঁচতে ঘৃণার এই মানসিক প্রক্ষেপ অন্যের উপরে উগরে দেওয়া!
জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওযার পর থেকে দীপিকা পাড়ুকোন যে ভাবে ট্রোলের শিকার হচ্ছেন— কেউ বলছেন, ওঁর মুখে অ্যাসিড ছোড়া উচিত, কেউ বা বলছেন, উনি আসলে মুসলমান, নাম দীপিকা ফতিমা পাড়ুকোন ইত্যাদি— তাতে সমাজবিজ্ঞানী আশিস নন্দীর এমনটাই মনে হচ্ছে।
আশিসবাবু জানেন, বলিউড এবং ক্রিকেট এ দেশের জনজীবনে অন্যতম ধর্ম। ফলে, ধোনি কেন রান নিতে পারছেন না বা ক্যাটরিনা কাইফ কেন আগের মতো হিট দিতে পারছেন না, তা নিয়ে কথা হবেই। ‘‘কিন্তু দীপিকাকে নিয়ে যে ট্রোল, সেটা তাঁর অভিনয়ক্ষমতা বা ছবির গুণাগুণ নিয়ে কথা নয়। শত্রু খোঁজ এবং তাকে ঘৃণা করো, তাকে সামাজিক ও রাজনৈতিক ভাবে অচ্ছুৎ প্রতিপন্ন কর— আজকের ভারতসম্রাটদের জাতীয়তাবাদের নিদর্শন এটাই,’’ বলছেন তিনি।
এই যে জাতীয়তাবাদের নামে ঘৃণার রাজনীতি, এখানেই ঘটে গিয়েছে পর্বান্তর। বছর কয়েক আগে দীপিকা অভিনীত সঞ্জয় লীলা ভন্সালীর ‘পদ্মাবত’ নিয়েও তুমুল হইচই বেধেছিল। রাজস্থানের করণী সেনা সেই ছবির বিরুদ্ধে বন্ধ ডেকে সিনেমা হল জ্বালিয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়েছিল। কিন্তু সে ছিল ছবির বিষয়বস্তু নিয়ে রাজপুত জাত্যভিমান। এ বার আর অভিমান-টভিমান নয়, জেএনইউ পড়ুয়াদের পাশে দাঁড়ানোর ‘অপরাধে’ দীপিকা হয়ে গিয়েছেন অচ্ছুৎকন্যা!
ফিল্মতাত্ত্বিক সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়ও আশিসবাবুর সঙ্গে একমত। তাঁর মনে আছে, ষাটের দশকে পাক-ভারত যুদ্ধের সময় এই ভাবেই দিলীপকুমারের বিরুদ্ধে কিছু কথা ছড়াচ্ছিল। ওঁর আসল নাম ইউসুফ খান, পাকিস্তানের লোক এবং ভারতের শত্রু ইত্যাদি। ‘‘কিন্তু সে সব রটনা তখন কল্কে পায়নি। কংগ্রেস রাজত্ব, নেহরু, ইন্দিরা কেউই প্রশ্রয় দেননি।’’ কিন্তু ইন্দিরার জরুরি অবস্থাতেই তো রেডিয়ো, দূরদর্শনে কিশোরকুমার নিষিদ্ধ হয়েছিলেন! ‘‘কংগ্রেসের তো ফ্যাসিবাদী প্রবণতা ছিলই,’’ সঞ্জয়বাবু আরও খোলসা করলেন, ‘‘কিন্তু ফ্যাসিবাদী প্রবণতা আর ফ্যাসিবাদ আলাদা। সকাল থেকে দীপিকাকে আক্রমণের ঘটনা বুঝিয়ে দিচ্ছে, ফ্যাসিবাদ কতটা ভয়ঙ্কর!’’
অতএব ‘পদ্মাবত’, জরুরি অবস্থার ‘কিসসা কুর্সি কা’, মায় গুলজারের ‘আঁধি’ ছবিতে সুচিত্রা সেন-ইন্দিরা গাঁধী ইমেজের সাদৃশ্য বা বৈসাদৃশ্য অন্য আমলের গল্প। সফদর হাশমির খুনের পর শাবানা আজমি সিরি ফোর্ট অডিটোরিয়ামে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের মঞ্চে প্রতিবাদ করেছিলেন। বিরোধীরা বলেছিলেন, ওটা অ্যাক্টিভিজমের জায়গা নয়। ওই অবধি! সর্বব্যাপী ঘৃণার হুঙ্কার ছিল না।
কিন্তু দেশটা কার? যারা ঘৃণা করবে তাদের? না আমাদের সকলের? ‘গৃহযুদ্ধ’ ছবির পরিচালক বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত এড়িয়ে যাচ্ছেন না এই যুদ্ধ-পরিস্থিতি, ‘‘এত ঘৃণা আগে কখনও দেখিনি। দীপিকা তো ‘ছপক’ ছবিতে অ্যাসিড আক্রান্ত মহিলার ভূমিকায়। তাঁকে যখন অ্যাসিড ছোড়ার হুমকি দেওয়া হয়, সেটা সিনেমার শক্তিমত্তা। কিন্তু খারাপ শক্তি। শক্তির ভাল খারাপ দু’টো দিকই আছে, এখন যেন শুধু খারাপের চিৎকার।’’ তবে সিনেমার শুভশক্তি দীপিকাকে জয়টীকাই পরাচ্ছে। অপর্ণা সেন টুইট করেছেন, ‘অভিনন্দন দীপিকা। দেশ তোমার এই সাহসিকতা মনে রাখবে।’ সঞ্জয়বাবুও মনে রাখছেন, ‘‘জনপ্রিয় সিনেমার একজন অভিনেত্রী এই সময়ে প্রকাশ্যে রাজনীতির পক্ষ নিচ্ছেন, অভিনন্দন জানাতেই হয়।’’
এই অভিনন্দনটাই আশার বার্তা। দীপিকা যে ছবি বেয়ে বলিউডে পা রেখেছিলেন, সেই ‘ওম শান্তি ওম’-এও একটা সংলাপ ছিল না? ‘পিকচার আভি বাকি হ্যায় দোস্ত!’