ক্ষমতা দখলের রাজনীতির সঙ্গে প্রতিশোধের মিশেল। মাদক আর বারুদের পোড়া গন্ধ মেশানো টানটান প্লটে প্রথম সিজনেই দর্শকদের বেঁধে ফেলেছিল ওয়েব সিরিজ ‘মির্জাপুর’। দ্বিতীয় সিজনেও মুন্না ভাইয়া-গুড্ডু পণ্ডিতদের এই অ্যাকশন ক্রাইম থ্রিলার গোগ্রাসে গিলছেন তাঁরা। অনেকের মতে, এই সিরিজের প্রধান চরিত্র মুন্না ত্রিপাঠী ওরফে মুন্না ভাইয়া আসলে উত্তরপ্রদেশের এককালের মাফিয়া ডন মুন্না বজরঙ্গির আদলে গড়া। কে এই মুন্না বজরঙ্গি?
উত্তরপ্রদেশের পূর্বাঞ্চল এলাকার এককালের ‘মুকুটহীন সম্রাট’ মুন্না বজরঙ্গির কাহিনি বলিউডি ফিল্মের থেকে থেকে কম নাটকীয় নয়। গ্যাংস্টার থেকে রাজনীতির আঙিনায় পা রাখা মুন্না বজরঙ্গির উত্থান হয়েছিল ত়়ড়ি়ৎ গতিতে। প্রায় দুই দশক ধরে উত্তরপ্রদেশের মির্জাপুর, জৌনপুর এবং বারাণসীতে এক সময় তারই রাজত্ব চলত। ওই সময়ের মধ্যে নানা অপরাধের সঙ্গে সঙ্গে ৪০টিরও বেশি খুনের সঙ্গে নাম জড়িয়েছে মুন্নার।
মুন্না বজরঙ্গির আসল নাম প্রেমপ্রকাশ সিংহ। জন্ম ১৯৬৭ সালে। তাঁর আদি বাসস্থান সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা না গেলেও অনেকেই জানিয়েছেন, ছোটবেলা থেকে বন্দুক-পিস্তলের প্রতি টান ছিল মুন্নার। পঞ্চম শ্রেণিতেই স্কুলের পড়াশোনায় ইতি।
মুন্নার জীবনের শুরুটা অবশ্য হয়েছিল কার্পেট বোনার কারিগর হিসেবে। কম বয়সেই অপরাধ জগতে প্রবেশ। ১৭ বছরে বয়সেই প্রথম খুন। এর পর ধীরে ধীরে সুপারি কিলার থেকে উত্তরপ্রদেশের মির্জাপুরের ডন হয়ে ওঠেন তিনি।
কম বয়সেই উত্তরপ্রদেশের জৌনপুরের মাফিয়া গজরাজ সিংহের দলে নাম লিখিয়েছিলেন মুন্না। উত্তরপ্রদেশের অপরাধ জগতের থেকে রাজনীতিতে পা রেখেছেন অনেকেই। ব্রিজভূষণ শরণ সিংহ, রঘুরাজ প্রতাপ সিংহ ওরফে রাজা ভাইয়া, ডিপি যাদবদের সেই তালিকায় যোগ হয়েছিল মুন্না বজরঙ্গিরও নাম।
অপরাধ জগতে হাতেখড়ির পর গজরাজ সিংহের ছত্রছায়া থেকে সরে গিয়ে নয়ের দশকে মুন্না নাম লিখিয়েছিলেন মুখতার আনসারির দলে।
নয়ের দশকে মুলায়ম সিংহ যাদবের আমলে উত্তরপ্রদেশে মাফিয়াদের রমরমা কম ছিল না। মুখতারের উত্থানও সে সময়। ১৯৯৬ সালে মউ বিধানসভা কেন্দ্র থেকে মুলায়মের দল সমাজবাদী পার্টির টিকিটে ভোটে লড়ে জিতেছিলেন তিনি। রাজনীতিতে আসার আগে মুখতার সে সময় ত্রাস ছড়িয়েছিলেন মাফিয়া হিসেবে। ধীরে ধীরে সেই মুখতারের ডান হাত হয়ে ওঠেন মুন্না।
মুখতারের উত্থানের সময় উত্তরপ্রদেশের ঘরে ঘরে আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করেছিল তাঁর দলবল। একে-৫৬ রাইফেলের পাশাপাশি অন্য অস্ত্রের ঝলকানি দেখা যেত ভাদোহী মউ, গাজিপুর, বারাণসী অথবা জৌনপুরের অলিগলিতে। আর মুন্নার নামের পাশে চকচক করত সুপারি কিলারের তকমা।
মাফিয়া যুদ্ধের কুৎসিত চেহারাটা প্রকাশ্যে এসে পড়ে যখন মুখতারের বিরোধী গোষ্ঠীর সঙ্গে তাঁর রেষারেষিটা তুঙ্গে ওঠে। মুখতারের প্রধান প্রতিপক্ষ সে সময় গাজিপুর জেলার মহম্মদাবাদ বিধানসভা কেন্দ্রের বিজেপি বিধায়ক কৃষ্ণানন্দ রাই। দেওবন্দ বিধানসভা কেন্দ্রের বিজেপি বিধায়ক ব্রজেশ সিংহের সঙ্গে হাত মিলিয়ে মুখতারকে কড়া টক্কর দিচ্ছিলেন কৃষ্ণানন্দ।
২০০১ সালে ব্রজেশের দলদলের সঙ্গে সংঘর্ষ বাধে মুখতারের সঙ্গীদের। মউ-লখনউ হাইওয়েতে সেই সংঘর্ষে মারা যায় মুখতারের বেশ কিছু সঙ্গী। দু’দলের মোট ৬ জন নিহত হয়।
প্রতিশোধের কাহিনি সেখানেই শেষ হয়নি। ২০০৫ সালে মুখতারের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী কৃষ্ণানন্দকে খুন করেন মুন্না। পরে মুন্নার শিকার হন আরও এক বিজেপি নেতা রামচন্দ্র সিংহ। মাফিয়ারাজের ‘জমি দখলের’ অভিযোগ ওঠে রাজনৈতিক মদতেরও।
উত্তরপ্রদেশের রাজনৈতিক মহলের একাংশের অভিযোগ, সমাজবাদী পার্টির পরোক্ষ মদতের লাভ পেয়েছিল মুখতার-মুন্নার দলবল।
নয়ের দশক থেকে শুরু করে পরের দু’দশক পর্যন্ত মুন্নার ত্রাস ছড়িয়ে পড়ে উত্তরপ্রদেশে। ওই রাজ্যের মাফিয়া যুদ্ধে একে-৪৭ রাইফেলের প্রথম ব্যবহার নাকি মুন্নার হাত ধরেই হয়েছিল। ভাদোহী মউ, গাজিপুর, বারাণসী অথবা জৌনপুরে মুন্নার ত্রাসের ছায়া দীর্ঘতর হচ্ছিল।
মুন্নার অপরাধের তালিকা তৈরি হলে তাতে বোধহয় উপরের দিকে থাকবে কৃষ্ণানন্দকে খুনের ঘটনা। ২০০৫ সালের নভেম্বরের দুপুরে ৬ জন সঙ্গীর সঙ্গে গাড়িতে ছিলেন কৃষ্ণানন্দ। সে সময় আচমকাই তাঁদের উপর হামলা চালান মুন্না এবং তাঁর দলবল।
কৃষ্ণানন্দকে খুনের সময় ৬টি একে-৪৭ রাইফেল থেকে ৪০০-রও বেশি গুলি চালিয়েছিলেন মুন্নারা। পাল্টা গুলি চললেও সে যাত্রা প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন মুন্না। ওই ঘটনার তদন্তে নেমেছিল সিবিআই। পরে তদন্তকারীরা জানিয়েছিলেন, ৭টি দেহ থেকে ৬৭টি বুলেট উদ্ধার করা গিয়েছিল। বহু পুলিশকর্তার মতে, উত্তরপ্রদেশের মাফিয়া যুদ্ধে সেটিই ছিল সবচেয়ে বড় সংঘর্ষ।
কৃষ্ণানন্দকে খুনের পর থেকেই উত্তরপ্রদেশ পুলিশের নজরে ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে যান মুন্না। ২০০৯-এ তাঁর মাথার দাম ওঠে ৭ লক্ষ টাকা।
উত্তরপ্রদেশে থাকা মুশকিল হয়ে ওঠায় ২০০৩ সালে মুম্বইতে পাততাড়ি গোটান মুন্না। ২০০৯ সাল পর্যন্ত সেখানেই স্ত্রী এবং ৩ সন্তানকে নিয়ে বসবাস করছিলেন।
২০০৯ সালে মুম্বইয়ের মালাড এলাকায় মুন্নাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। নিজের আসল নামেই সেখানে থাকছিলেন মুন্না। গ্রেফতারির পর জেলে ঠাঁই হয় তাঁর। জেলে থাকতে থাকতেই রাজনীতিতেও পা রাখেন মুন্না।
২০১২-তে মামলা চলাকালীন তিহাড় জেল থেকেই বিধানসভা ভোটে ল়ড়েন মুন্না। তবে মড়িয়াহু কেন্দ্রে সমাজবাদী পার্টির শ্রদ্ধা যাদবের কাছে হেরে যান তিনি।
এক সময়ের কালাশনিকভধারী মুন্নার জীবনের শেষটা হয়েছিল মর্মান্তিক ভাবে। ২০১৮ সালের ৮ জুলাই তাঁকে ঝাঁসির জেল থেকে বাঘপত জেলে নিয়ে যাওয়া হয়। তোলাবাজির অভিযোগে পরের দিন, সোমবার মুন্নাকে আদালতে পেশ করার কথা ছিল। সোমবার ভোর সাড়ে ৫টা নাগাদ জেল চত্বরেই মুন্নার দেহ ঝাঁঝরা করে দেয় সুনীল রাঠী নামে আর এক মাফিয়া।
মুন্নার খুনের ঘটনায় জেল আধিকারিকদের সাসপেন্ড করে বিচারবিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দিয়েছিলেন উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ। পুলিশ জানিয়েছিল, শুধুমাত্র মুন্নার মাথা থেকেই ১০টি বুলেট উদ্ধার হয়েছিল। কিন্তু, মুন্নাকে কেন খুন করেছিল সুনীল? উত্তরে সে জানিয়েছিল, তাকে ‘মোটা’ বলেছিলেন মুন্না!