সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের বিরোধিতা করে প্রতিবাদ চলছেই। রবিবার শাহিন বাগে। পিটিআই
কিছু দিন আগেই এক লপ্তে ৫,০০০ পোস্টকার্ড লিখতে বসেছিল শাহিন বাগ। হিন্দি, উর্দু, ইংরেজিতে তা লিখে পাঠানোর কথা বলেছিল দেশের প্রধান বিচারপতি এস এ বোবদের কাছে। বিষয়, সিএএ-এনআরসি বিরোধিতা। ঠিক যা নিয়ে কথা বলতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে নিমন্ত্রণ পাঠিয়েছেন দু’মাস রাস্তা রুখে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া প্রেম দিবসে আবার কাগজের গোলাপ সাঁটা ‘হার্ট’ চিহ্নে আর্তি— ‘দোহাই মোদীজি, আমাদের সঙ্গে দেখা করতে শাহিন বাগে আসুন!’
শাহিন বাগের মহিলাদের এই ‘ছক ভাঙা’ প্রতিবাদ নজর কেড়েছে সকলের। কেউ বলছেন, ‘‘স্পর্ধা।’’ তেমনই অনেকে তারিফ করছেন উদ্ভাবনী চিন্তার। গত কয়েক মাসে জেএনইউয়ের মিছিল, জামিয়ার প্রতিবাদ, শাহিন বাগের আন্দোলন কিংবা সিএএ-এনআরসি বিরোধী অন্যান্য বিক্ষোভেও যার ছোঁয়া ভুরি ভুরি।
জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়ায় মঞ্চ গড়ে বক্তৃতা, স্লোগান তো আছেই। সেই প্রতিবাদের বয়ানকে আরও বেশি করে আমজনতার ঘরে পৌঁছে দিতে সেখানে তৈরি হয়েছে ‘ডিটেনশন সেন্টারের’ মডেল। কখনও বা দিনভর দাঁড়িয়ে থেকে ধর্মীয় সম্প্রীতির বার্তা দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। শাহিন বাগে যখন লোহার ফ্রেমে ভারতের পেল্লাই মানচিত্র কিংবা ‘ইন্ডিয়া গেট’ মাথা তুলেছে, তখন জেএনইউয়ের মিছিলে রকমারি ব্যঙ্গচিত্র। যার অধিকাংশেরই নিশানা নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহ জুটি। দেশের আদর্শ মনে করাতে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের সমাবেশে জনপ্রিয় হয়েছে মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধী, বি আর অম্বেডকরের মুখোশও।
ছাত্র সংগঠন এআইএসএ-র প্রেসিডেন্ট এন সাই বালাজির কথায়, ‘‘অধিকাংশ আন্দোলনের সঙ্গে যেহেতু পড়ুয়ারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে যুক্ত, তাই উদ্ভাবনী চিন্তার ছোঁয়া দেখা গিয়েছে প্রায় সর্বত্র। তা ছাড়া, কম খরচে বিজেপি ও সরকারের অপপ্রচারের পাল্টা বক্তব্য আমজনতার কানে পৌঁছে দিতে এ ছাড়া উপায় কী? ওদের বাজেটের কানাকড়িও তো আমাদের নেই।’’
বিপণনে মোদীর থেকে দক্ষ নেতা খুব কম আছেন বলে মানেন বিরোধীরাও। তবে পড়ুয়াদের একাংশের দাবি, এই প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বীকেও প্রচারে সমান তালে টক্কর দিয়ে গিয়েছেন আন্দোলনকারীরা। মোদী বিজেপিকে সমর্থনে মোবাইল টর্চ জ্বালানোর কথা বলেন, তো সম্প্রতি অন্ধকারে আলো জ্বেলে প্রতিবাদে শামিল হয়েছিলেন আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েক জন পড়ুয়া। দাবি, দেশে ঘোর অন্ধকার। তাই বেরনোর রাস্তা খুঁজছেন তাঁরা!
এক ছাত্রনেতার কথায়, ‘‘জাতীয় পতাকা আর সংবিধানেরই যে রকম বুদ্ধিদীপ্ত ব্যবহার হয়েছে, তার জুড়ি মেলা ভার।’’ কখনও জামা মসজিদের চত্বরে সংবিধান মাথার উপরে ধরে প্রায় মাটি ফুঁড়ে উদয় হয়েছেন ভীম সেনার নেতা চন্দ্রশেখর আজাদ। শাহিন বাগের মঞ্চ থেকে পড়ুয়াদের মিছিল— প্রতিবাদের প্রায় সমস্ত জায়গা ছয়লাপ তেরঙা পতাকায়। এক পড়ুয়ার কথায়, ‘‘হাতে জাতীয় পতাকা থাকা কাউকে টিভি ক্যামেরার সামনে বেধড়ক লাঠিপেটা করা কিংবা সটান দেশদ্রোহী বলে দেগে দেওয়া কিছুটা হলেও কঠিন হয় না কি?’’ তা বলে লাঠি যে পড়েনি, তেমন দাবিও নেই।
বিজ্ঞাপন দুনিয়ার কিংবদন্তি ডেভিড ওগিলভির একটি গল্প অনেকের মুখে-মুখে ফেরে। নিজের প্রথম কাজ হিসেবে নাকি খুব কম ‘বাজেটে’ এক নতুন হোটেলের বিজ্ঞাপন তৈরির দায়িত্ব পেয়েছিলেন তিনি। ওই টাকায় তা সম্ভব নয় বুঝে এক গোছা সুন্দর ছবিওয়ালা পোস্টকার্ড কেনেন ওগিলভি। সুন্দর করে লিখে তা পাঠিয়ে দেন শহরের তাবড় সেলিব্রিটিদের। তাঁরা আসায় বিজ্ঞাপনে বাজিমাত। হোটেলও সুপারহিট।
পরিস্থিতি আর প্রয়োজনই তো উদ্ভাবনের জননী।