লড়াকু: পুরস্কারের মঞ্চে সৌম্যদীপ জানা। নিজস্ব চিত্র
মাথায় আটকে বুলেটের টুকরো। একই ক্ষত ফুসফুসে। তিন মাস কোমায় থেকেছে বছর চোদ্দোর সেই ছেলে। চার বার ‘ব্রেন সার্জারি’। বাঁ দিক পক্ষাঘাতগ্রস্ত। দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ। গ্রেনেড বিস্ফোরণের প্রচণ্ড শব্দে ফেটে গিয়েছে ডান কানের পর্দা।
এ সবেও লড়াই ছাড়েনি পূর্ব মেদিনীপুরের চণ্ডীপুরের সৌম্যদীপ জানা। হুইলচেয়ারে বন্দি হয়েও জড়ানো গলায় সে বলে, ‘‘এখন অনেক ভাল আছি। ফিরব ব্যাডমিন্টন আর ফুটবলে।’’
লড়াইটা অবশ্য ভাল জানে সৌম্যদীপ। বাবা সেনাকর্মী। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে জম্মুর সেনাঘাটিতে জঙ্গিদের হাত থেকে মা, বোনকে বাঁচাতে গিয়েই জখম হয় সে। সেই শৌর্যের জন্য এ বার তাকে সাহসিকতার পুরস্কার দিয়েছে একটি বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা।
১০ ফেব্রুয়ারি। জম্মুর সুঞ্জওয়ানে ভোরের আলো তেমন ফোটেনি।
জংলা পোশাকে সেনাঘাঁটিতে হামলা চালায় জইশের ‘আফজল গুরু স্কোয়াড’-এর সশস্ত্র তিন ফিদায়েঁ
জঙ্গি। শিবিরের রক্ষীদের সঙ্গে সংঘর্ষের পরে সেনাদের পরিবারের থাকার জায়গায় ঢুকে পড়ে জঙ্গিরা। হানাদারদের এলোপাথাড়ি বুলেট-বর্ষণে প্রাণ হারান এক সেনা অফিসার ও সুবেদার।
এখন দিল্লিতে সেনার ‘রিসার্চ অ্যান্ড রেফারেল হাসপাতাল’-এ চিকিৎসা চলছে সৌম্যদীপের। সোমবার সেখান থেকেই ফোনে তার বাবা সেনা হাবিলদার হরিপদ জানা জানান, সে দিন গ্রেনেড, গুলির আওয়াজে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল তাঁদের সকলের। কর্তব্যের খাতিরে হরিপদবাবু বেরিয়ে যান বাড়ি থেকে। অন্য দিক দিয়ে জঙ্গিরা এগিয়ে যায় তাঁরই বাড়ির দিকে। বিপদ বুঝে মা মধুমিতাদেবী, ন’বছরের বোন স্নেহাকে নিয়ে একটা ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয় সৌম্যদীপ। কিছু আসবাব, লোহার সিন্দুক টেনে দরজার সামনে ঠেস দিয়ে রাখে। সে সবের উপরে বসে পড়ে নিজেও। তত ক্ষণে সদর দরজার ছিটকিনি বুলেট ছুড়ে ভেঙে ভিতরে ঢুকে পড়ে জঙ্গিরা। ঘরের দরজা বন্ধ দেখে ধাক্কা দিয়ে খোলার চেষ্টা করে।
না পেরে দরজার সামনে গ্রেনেড ছোড়ে। স্প্লিনটার গেঁথে যায় সৌম্যদীপের শরীরে। বন্ধ দরজার বাইরে থেকেই এ কে ৫৬ রাইফেল থেকে এলোপাথাড়ি গুলি চালায় জঙ্গিরা। তাতে মারাত্মক জখম হয় সৌম্যদীপ। গোলাগুলির আওয়াজে ওই বাড়ির দিকে এগিয়ে যায় সেনারা। বেগতিক দেখে পালায় জঙ্গিরা। পরে সংঘর্ষে মৃত্যু হয় তিন জঙ্গির।
ওই ঘটনার সময় আর্মি
পাবলিক স্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে
পড়ত সৌম্যদীপ। হরিপদবাবু জানান, ভাল খেলত ব্যাডমিন্টন, ফুটবলও। হাঁটাচলা তো দূর, এখন পড়তে-লিখতে পারে না সৌম্যদীপ। কোমায় যাওয়ার আগের কোনও কথা মনেও পড়ে
না তার।
ছেলে পুরস্কার পেলেও একটা আক্ষেপ রয়ে গিয়েছে বাবার। হরিপদবাবু বলেন, ‘‘সরকারি তরফে ওই স্বীকৃতি পেলে আরও ভাল লাগত।’’ আর পুরস্কারে আনন্দ পেলেও ঘরের ছেলের সুস্থতা নিয়ে বেশি চিন্তিত পূর্ব মেদিনীপুরের পায়রাচালির দলবার গ্রামে সৌম্যদীপের পরিজনেরা। তার জ্যাঠা মধুসূদন জানার কথায়, ‘‘জীবন বাজি রেখে অন্যদের বাঁচাল। কিন্তু ও নিজে তো অনেক কিছু হারাল।’’