ফাইল চিত্র।
ছোটদের বিরুদ্ধে অপরাধও কি ‘ছোট’ অপরাধ? প্রশ্নটা উঠছে দেশের জুভেনাইল আইনের নতুন সংশোধনী নিয়ে। কারণ, সেই আইনে এ দেশে ছোটদের যে কোনও মতলবে বিক্রি, নিয়োগের মতো অপরাধও আর পুলিশি তদন্ত বা এফআইআর-এর জন্য যোগ্য নয় (নন-কগনিজ়েব্ল) বলে ‘ছাড়’ দেওয়া হয়েছে।
ছোটদের বিরুদ্ধে অপরাধের আইনি সুরক্ষায় ভরসা ২০১৫ সালের এই আইন। তার বেশ কয়েকটি ধারায় সম্প্রতি ‘নন-কগনিজ়েব্ল’ বলে ছাড় দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়ে পদক্ষেপ করেছে পশ্চিমবঙ্গ-সহ আরও চারটি অ-বিজেপি রাজ্যের শিশু সুরক্ষা কমিশন। ছোটদের সুরক্ষার স্বার্থে আইনে এই ‘ভয়ানক’ সংশোধনীগুলি অবিলম্বে প্রত্যাহার করার আর্জি জানিয়ে পশ্চিমবঙ্গ, দিল্লি, রাজস্থান, পঞ্জাব, চণ্ডিগড়ের শিশু সুরক্ষা কমিশন কেন্দ্রীয় নারী ও শিশুকল্যাণ সচিব ইন্দিবর পান্ডেকে চিঠি লিখেছেন।
কেরলের শিশু সুরক্ষা কমিশনও বিষয়টি নিয়ে আলাদা ভাবে পদক্ষেপ করছে বলে জানান রাজ্যের শিশু সুরক্ষা কমিশনের চেয়ারপার্সন অনন্যা চক্রবর্তী। এ মাসের প্রথম সপ্তাহে বাংলা-সহ বিভিন্ন রাজ্যের তরফে চিঠিটি গিয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের জুভেনাইল জাস্টিস কমিটির রেজিস্ট্রার, দেশের অ্যাটর্নি জেনারেল প্রমুখকেও চিঠির কপি পাঠানো হয়েছে। সাড়া না-মিললে তাঁরা আদালতের দ্বারস্থ হবেন বলে অনন্যা জানিয়েছেন।
জুভেনাইল জাস্টিস আইনে শিশু পরিচর্যা কেন্দ্র বা হোমে ছোটদের উপরে নিষ্ঠুরতা, ছোটদের ভিক্ষা করানো বা মাদক দেওয়া, মাদক-কারবারে ছোটদের কাজে লাগানো, শিশু শ্রমিকের শোষণ, ছোটদের বিক্রি বা কুকাজে নিয়োগ, এমনকি কোনও জঙ্গি গোষ্ঠীর হাতে ছোটদের ব্যবহৃত হওয়ার মতো গুরুতর অপরাধও এখন নন-কগনিজ়েবল। এর অর্থ, এই ধরনের অপরাধে পুলিশ স্রেফ ‘জেনারেল ডায়েরি’ নথিভু্ক্ত করেই কার্যত দায়মুক্ত হবে। এফআইআর করার বাধ্যবাধকতা থাকবে না। অনন্যা বলেন, ‘‘শুধু তা-ই নয়, সমাজে তুলনায় পিছিয়ে-থাকা শ্রেণির ছোটরা এই সংশোধনীতে সব থেকে মুশকিলে পড়বে। ক’জন জানেন, তাঁর বসবাসের এলাকায় বিচারবিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেট কোথায় থাকেন? ক’জন সহজে উকিলের বন্দোবস্ত করতে পারেন? শিশু সুরক্ষায় বছর-বছর বাজেট কমছে। ২০১৫র জুভেনাইল জাস্টিস কেয়ার অ্যান্ড প্রোটেকশন অ্যাক্টে শিশুদের সঙ্গে ঘটা অপরাধে আইনি সুরক্ষা একটা ইতিবাচক দিক ছিল। সেটাও নষ্ট করা হচ্ছে।’’
এমন আইন লোকসভা, রাজ্যসভায় কী করে পাশ হয়ে গেল, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। লোকসভায় আলোচনা ছাড়াই সংখ্যাধিক্যের জোরে আইনটি পাশ করানো হয় বলে মনে করা হচ্ছে। যেমন রাজ্যসভায় কৃষি বিল বিরোধিতার সময়ে বিরোধী সাংসদদের অনুপস্থিতি কাজে লাগানো হয়েছিল। তবে এনসিপি সাংসদ সুপ্রিয়া সুলে, রাজ্যসভার প্রতিনিধি জয়া বচ্চন বিষয়টি নিয়ে আলাদা ভাবে সরব হচ্ছেন বলে সূত্রের খবর।
কোনও কোনও মহল থেকে বলা হচ্ছে, আইনের সঙ্গে সংঘাতে থাকা শিশুদের গ্রেফতারি থেকে বাঁচাতে এই ‘নন-কগনিজ়েব্ল’ ধারার ব্যবহার করা হয়েছে। প্রেমে পড়ে দু’জন নাবালকের পালানোর ঘটনায় নাবালক প্রেমিকটির প্রতি কিছুটা সহৃদয় হতে এই আইন সাহায্য করবে বলে মনে করা হচ্ছে।
কিন্তু জুভেনাইল জাস্টিস আইনে ছোটদের গ্রেফতারিতে সুরক্ষার অন্য ব্যবস্থা রয়েছে বলে আইনজ্ঞেরা মনে করেন। আবার সংশোধনীতে ‘নন-কগনিজ়েব্ল’ অপরাধগুলিকে জামিনঅযোগ্যও বলা হয়েছে, যা স্ববিরোধী বলে মনে করছেন কমিশনের প্রতিনিধি ও উপদেষ্টারা। অনন্যা বলেন, ‘‘ভারত রাষ্ট্রপুঞ্জের শিশু অধিকার সম্মেলনের চুক্তিতে দায়বদ্ধ। শিশু সুরক্ষার আইনগুলি এত লঘু হলে, সে-ই চুক্তিরও দফা রফা।’’