ট্রেন দুর্ঘটনায় মৃত ছেলের ছবি নিয়ে কান্না মায়ের। ছবি: পিটিআই।
সুরক্ষা অভিযান মৃত্যুর পরে, কর্মী কোথায়
প্রায় তিনশো প্রাণের বিনিময়ে নড়েচড়ে বসল রেল বোর্ড।
করমণ্ডলের দুর্ঘটনার পরে দেশের সবক’টি জ়োনে ‘সেফটি ড্রাইভ’ শুরু করার সিদ্ধান্ত নিল রেল মন্ত্রক। বিশেষ করে সিগন্যালিং ব্যবস্থায় কোনও গোলমাল রয়েছে কি না তা চূড়ান্ত অগ্রাধিকার দিয়ে দেখতে বলা হয়েছে। চার মাস আগেই সিগন্যালিং ব্যবস্থায় ত্রুটি আঁচ করে সামগ্রিক সিগন্যালিং ব্যবস্থা খতিয়ে দেখার প্রস্তাব দিয়েছিল দক্ষিণ-পশ্চিম রেল। বিরোধীদের বক্তব্য, সে সময়ে সাবধান হলে সম্ভবত দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে যেত করমণ্ডল।
এ বার দ্রুত সুরক্ষা অভিযান শুরু করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে সব ক’টি জোনকে। বিশেষ ভাবে নজরদারি চালাতে বলা হয়েছে পয়েন্ট-সিগন্যালের মধ্যে সমন্বয় হচ্ছে কি না, তা খতিয়ে দেখার উপরে। সিগন্যালিং-এ গন্ডগোল ধরা পড়ছে কি না সে বিষয়ে আগামী ১৪ জুনের মধ্যে সমস্ত জোনকে রিপোর্ট জমা দিতে বলা হয়েছে। এখন প্রশ্ন উঠেছে, দেশের প্রায় ৭০ হাজার কিলোমিটার নেটওয়ার্কে ওই সুরক্ষা অভিযান চালানোর মতো লোক কোথায়? কারণ, রেলের যে পদাতিক বাহিনী ওই কাজ করে, তাদের নিয়োগ দীর্ঘ সময় ধরে কার্যত বন্ধ। এই ঘটনা কেবল অশ্বিনী বৈষ্ণবের সময়েই নয়, ইউপিএ আমলে লালুপ্রসাদ যাদব বা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আমল থেকেই রেলের সুরক্ষাসংক্রান্ত পদগুলি পূর্ণ করার প্রশ্নে গা-ছাড়া মনোভাব দেখা গিয়েছিল। সেই প্রবণতা আজও বহাল।
পরিসংখ্যান বলছে, এই মুহূর্তে রেলে অন্তত তিন লক্ষ নন গেজেটেড পদ খালি রয়েছে। যাদের বড় অংশই সেই সব রেলকর্মী যাঁরা পায়ে হেঁটে রেলের সামগ্রিক পরিকাঠামো খতিয়ে দেখেন। মূলত রেল পরিচালন ব্যবস্থার নিরাপত্তাজনিত বিষয়গুলি খেয়াল রাখাই তাঁদের প্রধান কাজ। রেল যতই মুখে যাত্রী নিরাপত্তা প্রাথমিক কর্তব্য বলে দাবি করুক না কেন, সংসদের গত শীতকালীন অধিবেশনে রাজ্যসভায় একটি প্রশ্নের উত্তরে অশ্বিনী বৈষ্ণব জানান, ২০২২ সালের ১ ডিসেম্বর পর্যন্ত রেলে ৩.১২ লক্ষ নন গেজেটেড পদ খালি রয়েছে। যাঁদেরবড় সংখ্যক নিচু তলার কর্মী। এই পদগুলির মধ্যে রয়েছে গ্যাংম্যান/ট্র্যাকম্যান, খালাসি, পেট্রোলম্যান। এঁরা যেমন একেবারে পথে নেমে লাইনের নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করেন, তেমনি পদ খালি রয়েছে লোকো ইন্সপেক্টর, সিগন্যাল-টেলিকমিউনিকেশন, ট্র্যাফিক ইন্সপেক্টর, ট্রলিম্যান, গেটকিপার, ব্রিজ ইন্সপেক্টর পদেও। এঁদের কাজও রেলের নিরাপত্তার সঙ্গে জড়িত।
কর্মী কম থাকায় এ সব পদে কাজের চাপ আগের চেয়ে কয়েক গুণ বেড়ে গিয়েছে। ফলে কাজের মানে তার প্রভাব পড়ছে। অভিজ্ঞ কর্মীর অভাবে যথেষ্ট বিশ্রাম পাচ্ছেন না দূরপাল্লার চালকেরাও। যা অনেক সময়েই দুর্ঘটনা ডেকে আনছে। সে কারণে দীর্ঘ সময় ধরে নিচুতলায় কর্মী নিয়োগের প্রশ্নে সরব রয়েছে অল ইন্ডিয়া রেলওয়ে মেনস্ ফেডারেশন। ছয় মাস আগে সিএজি রিপোর্টে গত এক বছরে চালকের কারণে একাধিক ট্রেনের লাইনচ্যুত হওয়ার ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে। এই সব দুর্ঘটনার বড় কারণ চালকের সিগন্যাল বুঝতে ভুল করা। বিশেষজ্ঞদের মতে, যথেষ্ট বিশ্রাম না পাওয়া এ ধরনের ভুলের পিছনে অন্যতম বড় কারণ। সিএজি রিপোর্টে এও বলা হয়েছে, ২০১৭-১৮ থেকে ২০২০-২১ পর্যন্ত ট্রেন দুর্ঘটনার ৭০ শতাংশের জন্য দায়ী হল ট্রেনের লাইনচ্যুত হওয়া। মূলত লাইনে ফাটল, মেরামতি ও রক্ষণাবেক্ষণে ত্রুটি ও পরিচালন ব্যবস্থায় ভুলের কারণে ওই দুর্ঘটনাগুলি ঘটেছে। সিএজি-র পর্যবেক্ষণ পুরনো লাইন পাল্টে ফেলে নতুন লাইন পাতার কাজে রেলের অর্থ বরাদ্দ কমেছে। এমনকি যে অর্থ বরাদ্দ হচ্ছে, তাও ঠিক ভাবে খরচ হচ্ছে না। সিএজি-র দাবি, ২০১৭-২১ সালে হওয়া লাইনচ্যুতির ২৬ শতাংশ ঘটনার জন্য দায়ী পুরনো ট্র্যাক।
যদিও রেলের দাবি, ফি বছর নিরাপত্তা খাতে রেলে অর্থ বরাদ্দ বেড়েছে। আজ রেলের পক্ষ থেকে পরিসংখ্যান দিয়ে দাবি করা হয়েছে, ট্র্যাক বদলানোর খাতে ২০১৭-১৮ সালে যেখানে ৮,৮৮৪ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছিল, ২০২০-২১ সালে তা বেড়ে হয়েছে ১৬,৫৮৮ কোটি। তেমনি দশ বছরের ইউপিএ জমানায় (২০০৪-১৪) রেলের নিরাপত্তা খাতে যেখানে ৭০,২৭৪ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছিল, সেখানে মোদী সরকারের আমলে নিরাপত্তাখাতে বরাদ্দ বেড়েছে আড়াই গুণ। ওই সময়ে নতুন ট্র্যাক বসানো, লেভেল ক্রসিং, সেতু সংস্কার, সিগন্যালিং ব্যবস্থার আধুনিকীকরণে ১,৭৮,০১২ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে।