রাফাল-মিটিওর যুগলবন্দি এশীয় আকাশসীমায় সামরিক ভারসাম্যের ছবিটাই বদলে দিতে পারে, বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
ফ্রান্সের সঙ্গে এমন এক চুক্তিতে যাচ্ছে ভারত, যাতে অনেকটা বদলে যেতে পারে এশিয়ার সামরিক ভারসাম্যের ছবিটা। রাফাল যুদ্ধবিমান কেনার বিষয়ে ফ্রান্সের সঙ্গে যে ভারতের দীর্ঘ আলোচনা আর দর কষাকষি চলছে, তা কারও অজানা নয়। কিন্তু শুধু রাফাল যে নয়, সঙ্গে যে আরও এক মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া অস্ত্রও কিনতে চলেছে ভারত, তা এত দিন প্রকাশ্যে আসেনি। রাফাল থেকে নিক্ষেপযোগ্য ‘মিটিওর’ ক্ষেপণাস্ত্র কেনার চুক্তিও একই সঙ্গে সেরে ফেলতে চলেছে ভারত। রাফাল-মিটিওর-এর যুগলবন্দি নাকি ভারতীয় বায়ুসেনাকে চিনা বিমানবাহিনীর থেকেও অনেকটা এগিয়ে দেবে, বলছেন প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞরা।
মিটিওর ক্ষেপণাস্ত্র কী?
ফ্রান্সে তৈরি এই আকাশ-থেকে-আকাশ ক্ষেপণাস্ত্র যুদ্ধবিমান থেকে নিক্ষেপ করার জন্যই তৈরি হয়েছে। ফরাসি ক্ষেপণাস্ত্র মিটিওরকে পৃথিবীর সেরা আকাশ-থেকে-আকাশ ক্ষেপণাস্ত্র হিসেবে মানে গোটা বিশ্বই। রাফাল যুদ্ধবিমান থেকে মিটিওর ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে ১০০ কিলোমিটার দূরে থাকা প্রতিপক্ষ যুদ্ধবিমানকে ধ্বংস করে দেওয়া যায়। এই ফরাসি ক্ষেপণাস্ত্রটির সঙ্গে তুলনায় আসার মতো ক্ষেপণাস্ত্র একমাত্র আমেরিকার হাতে রয়েছে। এআইএম-১২০ডি নামে সেই মার্কিন ক্ষেপণাস্ত্রটিও আকাশে ১০০ কিলোমিটার দূরবর্তী লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারে। কিন্তু ‘নো এস্কেপ জোন’-এর নিরিখে মার্কিন ক্ষেপণাস্ত্রটি মিটিওর-এর চেয়ে অনেক পিছিয়ে।
নো এস্কেপ জোন কী?
এটি হল আকাশ-যুদ্ধের একটি পরিচিত পরিভাষা। যে কোনও ক্ষেপণাস্ত্রের একটি নির্দিষ্ট নো এস্কেপ জোন থাকে। রেখাচিত্রে দেখানো হলে নো এস্কেপ জোনকে তিনকোনা বা অনেকটা পিরামিডের মতো দেখতে হয়। যে লক্ষ্যবস্তুর দিকে ক্ষেপণাস্ত্রটি ছোড়া হয়, নিক্ষেপের সময় সেই লক্ষ্যবস্তু যদি ওই পিরামিড আকৃতির এলাকা অর্থাৎ নো এস্কেপ জোনের মধ্যে থাকে, তা হলে উদ্ধার পাওয়ার কোনও উপায় নেই। ক্ষেপণাস্ত্র তাকে আঘাত করবেই।
মিটিওর-এর নো এস্কেপ জোন তুলনীয় মার্কিন ক্ষেপণাস্ত্র এআইএম-১২০ডি-এর নো এস্কেপ জোনের তুলানয় চার গুন বড় বলে প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের দাবি।
মিটিওর অপ্রতিরোধ্য কেন?
সমর বিশারদরা বলছেন, মিটিওরের র্যামজেট ইঞ্জিনই তাকে অপ্রতিরোধ্য করে তুলেছে। অধিকাংশ আকাশ-থেকে-আকাশ ক্ষেপণাস্ত্রের মতোই, মিটিওর ক্ষেপণাস্ত্রও নিক্ষিপ্ত হওয়ার সময়ে কঠিন জ্বালানির উপরে নির্ভর করে। কিন্তু তীব্র গতিতে লক্ষ্যবস্তুর দিকে ছুটতে শুরু করার পর মিটিওর ক্ষেপণাস্ত্র একটি শ্যুট উন্মুক্ত করে দেয়, যাতে ইঞ্জিনের মধ্যে তীব্র বেগে হাওয়া ঢুকতে পারে। সেই হাওয়া অক্সিজেনকে উত্তপ্ত করে তোলে এবং ইঞ্জিনের গতি বাড়িয়ে ক্ষেপণাস্ত্রটিকে শব্দের গতিবেগের চার গুণ বেগে ছোটাতে শুরু করে।
এই তীব্র বেগের কারণেই প্রতিপক্ষের বিমান মিটিওরের নো এস্কেপ জোন ছেড়ে পালানোর আগেই আঘাতের শিকার হয়। ‘সিকার’ প্রযুক্তিতে সমৃদ্ধ হওয়ায়, লক্ষ্যবস্তু অবস্থান বদলালে এই ক্ষেপণাস্ত্রও তার অভিমুখ বদল করতে থাকে এবং লক্ষ্যবস্তুর দিকে নির্ভুল ভাবে ছুটে যায়।
পাক বিমান বাহিনী এমনিতেই ভারতীয় বায়ুসেনার সক্ষমতার চেয়ে অনেকটা পিছিয়ে পড়েছে। এশিয়া মহাদেশে একমাত্র চিনা বিমানবাহিনীই ভারতীয় বায়ুসেনাকে কঠিন পরিস্থিতির মুখে ঠেলতে পারে। কিন্তু ৩৬টি রাফাল যুদ্ধবিমান এবং তার সঙ্গে মিটিওর ক্ষেপণাস্ত্র ভারতীয় বায়ুসেনার হাতে এলে, চিনকেও যথেষ্ট চাপে পড়তে হবে। এয়ার সুপ্রিম্যাসি বা আকাশে প্রতিপক্ষকে টেক্কা দিয়ে আধিপত্য কায়েম করতে রাফাল এমনিতেই অত্যন্ত পারদর্শী। সঙ্গে মিটিওর ক্ষেপণাস্ত্র থাকলে ভারতের রাফাল স্কোয়াড্রনের মুখোমুখি হওয়া চিনা বিমানবাহিনীর পক্ষেও খুব কঠিন হয়ে যাবে।
আরও পড়ুন: মোদী-ঘানি কথা, সন্ত্রাস প্রশ্নে বার্তা পাকিস্তানকে
রাফাল চুক্তি নিয়ে ভারত ও ফরাসি সরকারের মধ্যে কথাবার্তা চূড়ান্ত হয়ে গিয়েছে। ফরাসি প্রতিনিধি দল গত কয়েক দিন ধরেই দিল্লিতে। তাঁদের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতেই কথা চূড়ান্ত হয়েছে বলে সাউথ ব্লক সূত্রের খবর। প্রতিরক্ষা মন্ত্রক সূত্রে খবর, ৭৮৭ কোটি ইউরোর বিনিময়ে দু’দেশের মধ্যে যে চুক্তি হচ্ছে তাতে শুধু রাফাল যুদ্ধবিমান নয়, সঙ্গে ব্যবহার্য মিটিওর ক্ষেপনাস্ত্র পেতে চলেছে ভারত। আগামী ২৩ সেপ্টেম্বর রাফাল চুক্তি সই হচ্ছে।