মাত্র ১০ বছরের মেয়ের হাতে বন্দুক দেখে চমকে গিয়েছিলেন মহাত্মা গাঁধী। জানতে চেয়েছিলেন, কী হবে বন্দুক দিয়ে? উত্তরে ছিল আরও চমক। খুদে মেয়ে উত্তর দিয়েছিলে, সে বড় হয়ে বন্দুক দিয়ে ব্রিটিশদের মারবে!
বেশি দিন অপেক্ষা করতে হয়নি। মাত্র ষোলো বছর বয়সেই কিশোরী দেশসেবায় উৎসর্গ করেছিলেন নিজেকে। তাঁর হাতে ব্রিটিশ সাহেবের প্রাণ যায়নি ঠিকই। কিন্তু দেশকে স্বাধীন করার পিছনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল কিশোরী গুপ্তচর সরস্বতী রাজামণির।
সে কালের বর্মা, আজকের মায়ানমারে তাঁর জন্ম ১৯২৭ সালে। জন্মগত নাম ছিল রাজামণি। তাঁর বাবা ছিলেন তামিলনাড়ুর ত্রিচির বাসিন্দা। ব্রিটিশ পুলিশের হাত থেকে বাঁচতে পালিয়ে গিয়েছিলেন বর্মায়। সেখানে সোনার খনির মালিক হয়ে প্রচুর সম্পত্তি উপার্জন করেছিলেন।
সাবেক ইয়াঙ্গন, আজকের রেঙ্গুনে প্রাসাদের মতো বাড়িতে বড় হন রাজামণি। কিন্তু বৈভব কেড়ে নিতে পারেনি দেশকে স্বাধীন করার স্বপ্ন। তাঁদের বাড়িতে দেশপ্রেমের পরিবেশ প্রথম থেকেই ছিল। ফলে ছোট থেকেই রাজামণি ছিলেন পারিপার্শ্বিক সম্বন্ধে খুবই সচেতন।
রাজামণির যখন ১০ বছর বয়স, তাঁদের রেঙ্গুনের বাড়িতে এসেছিলেন মহাত্মা গাঁধী। তাঁকে আপ্যায়নের মাঝে বাড়িরে লোকের হঠাৎ খেয়াল হয়, রাজামণিকে পাওয়া যাচ্ছে না। তাঁদের সঙ্গে একরত্তি মেয়েকে খুঁজতে সামিল হন গাঁধীজিও।
শেষে বাড়ির বাগানে বন্দুক হাতে দেখা যায় ১০ বছরের রাজামণিকে। তাঁর মতো ছোট মেয়ের হাতে বন্দুক কেন, গাঁধীজির এই প্রশ্নের উত্তরে বালিকা রাজামণি বলেছিলেন, বড় হয়ে ব্রিটিশদের মারতে চান।
অত ছোট মেয়ের মুখে এই উত্তর শুনে চমকে যান গাঁধীজি। বলেন, তাঁরা অহিংস উপায়ে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াই করছেন। সরস্বতীরও উচিত অহিংসার পথ বেছে নেওয়া। শুনে বালিকার উত্তর ছিল, ‘‘আমরা তো ডাকাতদের মেরেই তাড়িয়ে দিই। ব্রিটিশরা তো আমাদের লুঠ করছে। তা হলে আমরা তাদের মারব না কেন?’’
অহিংসার পথে তাঁর আর যাওয়া হয়নি। নিজের জীবন সরস্বতী উৎসর্গ করেছিলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর পায়ে। তাঁকে রাজামণি দেখেছিলেন ষোলো বছর বয়সে। তখন নেতাজি এসেছিলেন রেঙ্গুনে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে তখন তাঁর লক্ষ্য ছিল স্বাধীনতার যুদ্ধে অর্থ সংগ্রহ এবং ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি বা আইএনএ-এর জন্য স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ।
ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে প্রত্যেক দেশবাসীকে অস্ত্র তুলে নিতে বলেছিলেন নেতাজি। তাঁর এই আহ্বান দাগ কেটে গিয়েছিল ষোড়শীর মনে। স্বপ্নের দেশনায়কের বক্তৃতা সামনে শুনে সেখানেই খুলে দিয়েছিলেন নিজের মূল্যবান গয়না।
পরের দিন খোঁজ নিয়ে রাজামণির বাড়িতে আসেন নেতাজি। তাঁর বাবাকে বলেন, রাজামণি হয়তো সরল মনে সব গয়না দিয়ে দিয়েছে। কিন্তু তিনি এত মূল্যবান গয়না নিতে পারবেন না।
নেতাজির সামনে স্মিত হেসে নীরব ছিলেন রাজামণির বাবা। তিনি এর আগেও নেতাজির দলে বহু অর্থ দান করেছেন। কিন্তু এ বার তাঁকে কোনও কথা বলতে না দিয়ে উত্তর দিলেন রাজামণি নিজে।
সুভাষচন্দ্র বসুর সামনে দাঁড়িয়ে দৃপ্তকণ্ঠে বলেছিলেন, ওই গয়না তাঁর বাবার নয়, বরং তাঁর নিজের। তাই তিনি স্বেচ্ছায় দেশের সেবায় গয়না দান করেছেন। আর ফিরিয়ে নেবেন না। তাঁর মানসিক দৃঢ়তাকে আর উপেক্ষা করতে পারেননি নেতাজি।
নেতাজি বলেন, ‘‘লক্ষ্মী আসেন, আবার চলেও যান। কিন্তু সরস্বতী একবার এলে আর যান না। তোমার মধ্যে মা সরস্বতীর জ্ঞান বিরাজ করছে। এখন থেকে আমি তোমার নাম দিলাম সরস্বতী।’’ তার পর থেকে তিনি পরিচিত হলেন সরস্বতী রাজামণি নামে। এবং পরবর্তী কালে তিনি পরিচিত হন সরস্বতী নামেই।
সে বারই চার জন বন্ধুর সঙ্গে রাজামণি যোগ দেন আইএনএ-তে, গুপ্তচর হিসেবে। ছেলের ছদ্মবেশে তাঁরা ফাইফরমাশ খাটার লোক হিসেবে যোগ দিতেন ব্রিটিশ মিলিটারি ক্যাম্প এবং অফিসারদের বাড়িতে। ব্রিটিশ সরকার ও সেনাবাহিনীর গোপন তথ্য আইএনএ-কে পাচার করাই ছিল তাঁদের কাজ।
ছেলের ছদ্মবেশে রাজামণি নাম নিয়েছিলেন ‘মণি’। তাঁদের কাজের মূলমন্ত্র ছিল, যা-ই হয়ে যাক না কেন, কোনওভাবেই ধরা পড়া চলবে না। কিন্তু সেই অঘটনই ঘটল এক দিন। ব্রিটিশ অফিসারদের হাতে ধরা পড়ে গেলেন ছদ্মবেশে থাকা রাজামণির এক বান্ধবী।
রাজামণি ঠিক করলেন, যে ভাবেই হোক উদ্ধার করতে হবে বান্ধবীকে। তিনি এ বার এক বানজারা মেয়ের ছদ্মবেশ নিলেন। নাচ দেখানোর ফাঁকে মাদক মেশানো খাবার খাওয়ালেন ব্রিটিশ অফিসারদের। তাঁরা যখন আচ্ছন্ন, রাজামণি উদ্ধার করলেন তাঁর বন্দি বান্ধবীকে।
ঊর্ধ্বশ্বাসে পালাতে লাগলেন দুই কিশোরী। কিন্তু বেশি দূর যেতে পারলেন না। রক্ষীরা তাঁদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ল। বুলেট বিদ্ধ হল রাজামণির ডান পা। রক্তাক্ত অবস্থাতেই ছুটতে লাগলেন তিনি।
উপায় না দেখে দু’জনে উঠলেন একটি গাছে। টানা তিন দিন সেখানেই লুকিয়ে থাকলেন। গাছে লুকিয়েই গুলিবিদ্ধ রাজামণি দেখলেন নীচে তাঁদের খোঁজে তোলপাড় করছে ব্রিটিশ পুলিশ।
এই ঘটনায় রাজামণির পায়ে স্থায়ী ক্ষত থেকেই গিয়েছিল। এর পর থেকে তিনি আজীবন খুঁড়িয়ে হাঁটতেন। সেটা তাঁর কাছে ছিল গর্বের। দুই কিশোরীর এই সাহসিকতায় খুশি হয়েছিলেন নেতাজি। জাপানের তৎকালীন সম্রাট নিজে পদক দিয়েছিলেন রাজামণিকে। আইএনএ-এর ঝাঁসির রানি ব্রিগেডে লেফটেন্যান্ট পদে উন্নীত হন রাজামণি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অক্ষশক্তির পরাজয়ের সঙ্গে সঙ্গে থেমে যায় আইএনএ-এর জয়যাত্রা। ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় এই যোদ্ধাদল। নেতাজির নির্দেশে সরস্বতী এবং আইএনএ-এর বহু সদস্য ভারতে ফিরে আসেন। কিন্তু তাঁদের পরিণতি হয়েছিল করুণ।
যুদ্ধবিধ্বস্ত রেঙ্গুন বা আজকের ইয়াঙ্গন থেকে ভারতে আসার পথে শেষ কপর্দকটুকু পর্যন্ত হারিয়ে ফেলেছিলেন রাজামণির পরিবার। ভারতে ফিরে ক্রমশ সঙ্গীন হতে থাকে তাঁদের অবস্থা।
দীর্ঘদিন রাজামণি ছিলেন চেন্নাইয়ের এক কামরার একটি ছোট্ট ফ্ল্যাটে। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর পুরনো ছবি ছিল তাঁর পড়ন্ত জীবনের বেঁচে থাকার স্মৃতি ও সম্বল। চারপাশে কেউ জানতেন না তাঁর প্রকৃত পরিচয়।
অবহেলিত ও বিস্মৃত রাজামণিকে নিয়ে সংবাদপত্রে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় ২০০৫-এ। স্বাধীনতা সংগ্রামীর সামান্য মাসোহারা দিয়ে অন্নসংস্থান করতে তিনি অসহায়। রাজ্য সরকারের কাছে আবেদন করায় তামিলনাড়ুর তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জয়ললিতার দফতর থেকে তাঁকে এককালীন ৫ লক্ষ টাকা সাহায্য করা হয়েছিল। থাকার জন্য ব্যবস্থা করা হয়েছিল একটি সরকারি আবাসনে। মকুব করা হয়েছিল ঘরের ভাড়া।
ওই বয়সেও নিজেকে হারিয়ে ফেলেননি রাজামণি। তিনি দর্জিদের দোকানে দোকানে ঘুরে ছিট কাপড়ের টুকরো সংগ্রহ করতেন। তারপর সেগুলো দিয়ে জামা বানিয়ে বিতরণ করতেন বিভিন্ন অনাথআশ্রমে। ২০০৪ সালে বিধ্বংসী সুনামির পরে রিলিফ-ফান্ডে দান করেছিলেন নিজের এক মাসের পেনশন।
২০১৮ সালের ১৩ জানুয়ারি প্রয়াত হন স্বাধীনতা সংগ্রামী সরস্বতী রাজামণি। তাঁর প্রতি ঋণভার দেশবাসী ভুলে গেলেও তিনি জীবনের শেষ দিন অবধি পালন করে গিয়েছেন দেশের প্রতি তাঁর কর্তব্য। (ছবি: আর্কাইভ, শাটারস্টক ও সোশ্যাল মিডিয়া)