সকালবেলা কাঁদতে কাঁদতে স্কুলে গিয়েছিল সাত বছরের বালিকা, কাঞ্চন। সে দিনই ছাড়তে হবে বাড়ি। জেনে গিয়েছে সে। স্কুল থেকে ফিরল ঘিঞ্জি একটা পাড়ায়। শুনল, সেটাই তাদের নতুন ঠিকানা। ঠাকুরদার তৃতীয় স্ত্রী বাড়ি থেকে উৎখাত করেছে তাদের। ঠাকুরদার প্রচুর সম্পত্তি থেকে বালিকার বাবার ভাগ্যে জুটেছিল স্রেফ একফালি জমি। এর পর বারবার ঠিকানা বদলাতে হয়েছে তাঁদের।
কাঞ্চনের বাবা এক বার জমি সংক্রান্ত বিবাদে জড়িয়ে পড়েছিলেন। নির্মমভাবে মার খেতে হয়েছিল তাঁকে। পুলিশের কাছে অভিযোগ জানাতে গিয়েও বিপত্তি। নেওয়া হয়নি এফআইআর। এই ঘটনা গভীর দাগ কেটেছিল কাঞ্চনের মনে। স্থির করেছিলেন, বড় হয়ে পুলিশ অফিসার হবেন। অন্যায় রুখে মানুষের পাশে দাঁড়াবেন।
নিজের কথা রেখেছিলেন কাঞ্চন চৌধরি। কিরণ বেদীর পরে তিনি দেশের দ্বিতীয় মহিলা আইপিএস এবং প্রথম মহিলা ডিজিপি। চলার পথ মোটেও মসৃণ ছিল না। তাঁর বাবা সামান্য জমিতে চাষ করতেন। মা ছিলেন গৃহবধূ। শত কষ্টেও আপস করেননি সন্তানদের পড়াশোনার সঙ্গে।
মদনমোহন চৌধরির বড় মেয়ে কাঞ্চনের জন্ম হিমাচলে, ১৯৪৭ সালে। বড় হওয়া অমৃতসর ও দিল্লিতে। দিল্লির ইন্দ্রপ্রস্থ কলেজ থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক। ১৯৯৩ সালে অস্ট্রেলিয়ার এক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে স্নাতকোত্তর। নিজেই এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, স্কুলে ছিলেন মাঝারি মাপের ছাত্রী। কলেজে গিয়ে আমূল পরিবর্তন।
বিতর্ক প্রতিযোগিতায় কাঞ্চন ছিলেন অসম্ভব পারদর্শী। তাঁকে বলা হত কলেজের গর্ব। কলেজের পরে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন তিনি। ছোটবেলার স্বপ্ন পূরণ করতে আমলা হিসেবে তিনি আইপিএস ছাড়া অন্য কিছু ভাবতেই পারেননি। তার আগে ঠাকুরদার সঙ্গে বাবার জমিজমা সংক্রান্ত মামলায় বহু বার পুলিশের দ্বারস্থ হয়েছিলেন কাঞ্চন। আবেদন করেছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধীর কাছেও।
আইপিএস অফিসার হওয়ার প্রশিক্ষণ পর্বে শিক্ষক ও প্রশিক্ষকরা ভেবেছিলেন, কাঞ্চন হয়তো পারবেন না। কিন্তু তাঁদের আশঙ্কা ভুল প্রমাণ করেছিলেন এই দৃঢ়চেতা সাহসিনী। বাবা মা ছাড়াও লড়াইয়ে আগাগোড়া তাঁর পাশে ছিলেন স্বামী দেব ভট্টাচার্য।
দেশের প্রথম ডেপুটি ইনস্পেক্টর জেনারেল হয়ে মেয়েদের রেখেই কর্মসূত্রে নতুন জায়গায় চলে যেতে হয়েছিল তাঁকে। মন খারাপ প্রশমিত করতে বাবা তাঁকে বলেছিলেন, নিজের মেয়েদের জন্য চিন্তা না করতে। বরং দেশের আরও অগণিত শিশু তাঁর অপেক্ষায় আছে।
কাঞ্চনের দুই মেয়ের শৈশব কেটেছে মূলত দাদু-দিদিমার কাছেই। তাই নিয়ে আক্ষেপ ছিল না কাঞ্চনের। বরং মনে হয়েছে মায়ের সঙ্গ বেশি না পাওয়ায় মেয়েরা অনেক বেশি স্বাবলম্বী হয়েছিল।
নিজের দুই নাতনিও স্বাবলম্বী হয়ে বড় হোক, বরাবর চেয়ে এসেছিলেন কাঞ্চন। অকুণ্ঠ ভাবে জানিয়েছিলেন তাঁর চলার পথে সর্বতোভাবে সাহায্য করে এসেছেন স্বামী। অবসরপ্রাপ্ত কাঞ্চন যখন নির্বাচনে আম আদমি পার্টি-র হয়ে ভোটে দাঁড়িয়েছিলেন, তখনও পাশে ছিলেন স্বামী। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে হরিদ্বার কেন্দ্র থেকে কাঞ্চন লড়াই করেছিলেন।
১৯৭৩ ব্যাচের আইপিএস কাঞ্চন ২০০৪ সালে উত্তরাখণ্ড পুলিশের ডিজি হয়েছিলেন। ৩৩ বছরের চাকরি জীবনে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ পদের দায়িত্ব পালন করেছেন। ছিলেন সিআইএসএফ-এর আইজি পদে। জাতীয় ব্যাডমিন্টন চ্যাম্পিয়ন সৈয়দ মোদী হত্যাকাণ্ড ও রিলায়্যান্স-বম্বে ডাইং মামলার মতো স্পর্শকাতর বিষয়ের তদন্তভার ছিল তাঁর উপর।
২০০৪ সালে মেক্সিকোয় ইন্টারপোলের বৈঠকে তিনি ভারতের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেন। জীবনভর কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৭৭ সালে পেয়েছিলেন রাষ্ট্রপতির পুলিশ পদক। সামগ্রিক পারফরম্যান্সের জন্য পেয়েছিলেন রাজীব গাঁধী পুরস্কারও।
১২। পাঁচ-ছ’মাসের অসুস্থতার পরে গত ২৭ অগস্ট প্রয়াত হন কাঞ্চন। রেখে গিয়েছেন তাঁর জীবন। যা পরবর্তী প্রজন্মের ভারতীয় মেয়েদের কাছে দৃষ্টান্ত। যে জীবনের উপরে ভিত্তি করেই তৈরি হয়েছিল দূরদর্শনের আটের দশকের জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ‘উড়ান’। নির্মাতা ছিলেন তাঁর বোন কবিতা। সেখানে অতিথি ভূমিকায় অভিনয়ও করেছিলেন কাঞ্চন— ভারতের প্রথম মহিলা ডিজিপি কাঞ্চন চৌধরি ভট্টাচার্য।