রঘুরাম রাজনের বিদায়ে বিদেশি লগ্নিকারীরা মুখ ফিরিয়ে নেবেন বলে আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল। আজ সকাল থেকে শেয়ার বাজারের মুখ ছিল ভার। টাকার দামও পড়তে শুরু করেছিল।
ঠিক সেই মুহূর্তেই চমকের মতো বিদেশি লগ্নির দরজা আরও চওড়া করে খুলে দিল নরেন্দ্র মোদী সরকার। প্রতিরক্ষা, বিমান, ওষুধ, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ থেকে খুচরো ব্যবসার মতো একগুচ্ছ ক্ষেত্রে বিদেশি লগ্নির দরজা কার্যত উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। খুচরো ব্যবসার ক্ষেত্রে বিভিন্ন শর্তও তুলে দেওয়া হয়েছে। এর ফলে এ দেশে আইফোন বিক্রির জন্য নিজস্ব বিপণি খুলতে পারবে অ্যাপল। এমনকী ভারতে আইফোন তৈরি করতেও পারবে। এত দিন নিরাপত্তার কারণে আর কেউ যে সাহস দেখায়নি, মোদী সরকার সেই প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রেও একশো ভাগ বিদেশি লগ্নির ছাড়পত্র দিয়েছে। অনলাইনে খাদ্যপণ্য বিপণনে আসতে পারে বিদেশি লগ্নি।
এত দিন আর্থিক বৃদ্ধির হার নিয়েই গর্ব করছিল মোদী সরকার। এ দিন প্রধানমন্ত্রী দাবি করেছেন, ‘‘ভারত এখন গোটা বিশ্বে সবথেকে খোলা অর্থনীতি।’’ কেন্দ্রের দাবি, এর ফলে শুধু যে নতুন বিদেশি লগ্নি ও প্রযুক্তি আসবে তা-ই নয়, আরও কর্মসংস্থান ও পরিকাঠামো তৈরি হবে। প্রধানমন্ত্রীর সাধের ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ নীতি সফল করার ক্ষেত্রেও এই সংস্কার সহায়ক হবে বলে মনে করা হচ্ছে। কারণ, এই নীতি রূপায়ণের পথে লগ্নিই অন্যতম প্রতিবন্ধক।
গত নভেম্বরে বিহারের ভোটে ধরাশায়ী হওয়ার পর বিদেশি লগ্নির দরজা খুলতে একগুচ্ছ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন মোদী। উদ্দেশ্য ছিল সরকার তথা বিজেপি নেতৃত্ব সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাব কাটানো। আজ রাজনের বিদায়ের পর মোদী সরকার বার্তা দিতে চেয়েছে, আর্থিক সংস্কার কোনও ব্যক্তিবিশেষের উপর নির্ভর নয়। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর বদলে যেতে পারেন, কিন্তু সে জন্য আর্থিক সংস্কার থমকে থাকবে না। বরং আরও জোরে ছুটবে তার ঘোড়া। যে বৈঠকে আর্থিক সংস্কারের সিদ্ধান্ত হয়েছে, সেটা হওয়ার কথা ছিল মঙ্গলবার। কিন্তু রাজন-বিদায়ের ধাক্কা নিয়ে আশঙ্কায় এক দিনও দেরি করতে চায়নি সরকার।
আজকের সিদ্ধান্তের পরে কয়েকটি নির্দিষ্ট তালিকাভুক্ত ক্ষেত্র ছাড়া অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সরাসরি বিদেশি লগ্নি আসতে পারবে। সংশ্লিষ্ট বোর্ডের ছাড়পত্রের জন্য অপেক্ষা করতে হবে না। প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে এত দিন শুধুমাত্র অত্যাধুনিক প্রযুক্তি এলেই ৪৯ শতাংশের বেশি বিদেশি লগ্নির অনুমতি ছিল। সেই শর্ত তুলে দেওয়া হয়েছে। যুদ্ধাস্ত্র আমদানির বদলে ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’-র নীতি মেনে ১০০ শতাংশ বিদেশি লগ্নিতে দেশেই তা তৈরির পথ খোলা হয়েছে। তবে বাণিজ্যমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণ দাবি করেছেন, এই কাজ করতে গিয়ে নিরাপত্তার সঙ্গে আপস করা হচ্ছে না।
পাশাপাশি, ওষুধ শিল্পে চালু প্রকল্পে সরাসরি ৭৪ শতাংশ বিদেশি লগ্নি আনার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। লগ্নির পরিমাণ তার বেশি হলে সরকারি ছাড়পত্র প্রয়োজন। অ্যাপলের মতো সংস্থাগুলির জন্য দরজা খুলতে দেশের বাজার থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ কাঁচামাল কেনার শর্ত সর্বোচ্চ আট বছরের জন্য শিথিল করা হয়েছে। কারণ অ্যাপল-এর যুক্তি ছিল, আইফোন বা অ্যাপলের অন্যান্য পণ্যের জন্য উন্নত প্রযুক্তির কাঁচামাল ভারতে মেলে না।
এ দিনের পদক্ষেপকে মুক্তকণ্ঠে স্বাগত জানিয়েছে শিল্পমহল। সিআইআই-এর ডিরেক্টর জেনারেল চন্দ্রজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘এর ফলে আর্থিক বৃদ্ধির হার বাড়বে। নতুন কর্মসংস্থানও হবে।’’ তবে একই সঙ্গে উঁকি দিচ্ছে আশঙ্কা। প্রশ্ন উঠছে, সরকার এই সংস্কারের গতি কি ধরে রাখতে পারবে? নাকি দু’পা এগিয়ে ফের এক কদম পিছিয়ে আসবে? আশঙ্কার কারণ হল, মোদী সরকার এর আগে জমি অধিগ্রহণ বিলে সংশোধন থেকে প্রভিডেন্ট ফান্ডে সুদের উপর কর বসানোর মতো সংস্কার ঘোষণা করেও পিছিয়ে এসেছে। ইউপিএ আমলের আর্থিক নীতির উপর সনিয়া গাঁধীর ঘনিষ্ঠ ঝোলাওয়ালা উপদেষ্টাদের দীর্ঘ ছায়া পড়তো। মোদী সরকারের বাজেটেও সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পের রমরমা। খোদ প্রধানমন্ত্রীই একশো দিনের কাজের পক্ষে সওয়াল করেছেন। বলেছেন, তাঁর সংস্কারের লক্ষ্য শিল্পপতিরা নন, গরিব মানুষরা।
শিল্পমহলের আশঙ্কা উস্কে আজ থেকেই বিরোধিতায় নেমেছে সঙ্ঘ-পরিবারের স্বদেশী জাগরণ মঞ্চ। মঞ্চের জাতীয় আহ্বায়ক অশ্বিনী মহাজন বলেন, ‘‘এ ভাবে বিদেশি লগ্নির দরজা খোলাটা মানুষের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা। এতে সরকার স্থানীয় ব্যবসায়ীদেরই ক্ষতি ডেকে আনল। এর ফলে চাকরি ও আয় কমবে।’’
কর্মসংস্থান বাড়বে— সরকারের এই দাবি হাতেকলমে প্রমাণিত হওয়ার আগেই বিদেশি সংস্থার প্রতিযোগিতার মুখে পড়বে এত দিন একচেটিয়া ব্যবসা করা দেশীয় সংস্থাগুলি। যাদের অনেকেই প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে কাজ করা রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা। এই সংস্থাগুলিতে যে হেতু এক ধরনের কায়েমি স্বার্থ কাজ করে, ফলে কর্মসংকোচনের ধুয়ো তুলে সরকারের অন্দরেই বিরোধী সুর মাথাচাড়া দিতে পারে বলে আশঙ্কা। আবার কংগ্রেসের আনন্দ শর্মা বা সিপিএমের সীতারাম ইয়েচুরিদের এক সুরে অভিযোগ, মার্কিন লবির কাছে মাথা নুইয়েই সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্র।
উত্তরপ্রদেশের ভোটের আগে ঘরে-বাইরে এই চাপ সরকারে কী ভাবে সামলায়, সেটাই দেখার।