রোমিলা থাপার।
ধর্মনিরপেক্ষ দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেও স্বাধীনতার ৭৩ বছর পরে ভারতবর্ষ হিন্দুরাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার কিনারায় দাঁড়িয়ে আছে বলে মনে করছেন ইতিহাসবিদ রোমিলা থাপার। বৃহস্পতিবার বিকেলে ফেসবুক লাইভে তাঁর প্রথম অনলাইন বক্তৃতা দেন জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের এমেরিটাস অধ্যাপক রোমিলা। সেখানেই তিনি বলেন, ‘‘দেশভাগের সময় ইসলামিক রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তানের সৃষ্টির সময় দ্বিজাতি তত্ত্বের ধারণাকেই অনুসরণ করা হয়েছিল। এটা বলা যেতেই পারে, বর্তমান ভারত এক হিন্দুরাষ্ট্র পরিণত হওয়ার কিনারায় দোদুল্যমান।’’
গত দু’শতক ধরে ভারতের ইতিহাস কী ভাবে রচনা করা হয়েছে তাই ছিল রোমিলার বক্তৃতার বিষয়। সেখানে তিনি যেমন এনেছেন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী ইতিহাসবিদদের কথা, তেমনই আলোচনা করেছেন জাতীয়তাবাদী ইতিহাসবিদদের ভূমিকা। উনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী ইতিহাসবিদরাই যে এই দ্বিজাতি তত্ত্বের উদ্ভাবক, সে কথা জানিয়ে রোমিলার আক্ষেপ, ‘‘সে সময়ের মতোই দুর্ভাগ্যজনকভাবে এখনকার সময়েও এই তত্ত্ব খুব প্রভাবশালী।’’ বর্তমান সময়ের কথা বারবার মনে করিয়ে দিয়েছেন রোমিলা। তাঁর মতে, ‘‘প্রচলিত বিশ্বাস, কল্পকাহিনি ইতিহাস নয়। যুক্তি, বুদ্ধি দিয়ে ইতিহাসের উপাদানকে বিচার করা গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্লেষণের এই পদ্ধতিই ইতিহাসবিদকে প্রশিক্ষণহীন স্বঘোষিত ইতিহাসবিদদের থেকে আলাদা করে, যাদের ইদানিং প্রায়ই দেখা যায়।’’ বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাসকে বদলে দিয়ে হিন্দুত্ববাদী ইতিহাস নির্মাণের অভিযোগ বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে বারবারই করেছে বিরোধীরা। শুক্রবারও রোমিলার মন্তব্যের কথা শেয়ার করে টুইটারে কেন্দ্রীয় সরকারকে বিঁধেছেন সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি। দলীয় মুখপত্রে তিনি লিখেছেন, ‘‘মোদী সরকার যে নতুন ভারতের কথা বলছে তা আসলে যুক্তি-বুদ্ধির উপরে আঘাত। ভারতের বহুত্ববাদের ইতিহাসের জায়গা নিচ্ছে কাল্পনিক মহাকাব্য, বিজ্ঞানমনস্কতার জায়গা নিচ্ছে অন্ধবিশ্বাস।’’
প্রসঙ্গত, গত বছর অক্টোবরে বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলেন, ‘‘ভারতের ইতিহাস ভারতের দৃষ্টিকোণ থেকে লিখতে হবে, কিন্তু কাউকে দোষারোপ করার দরকার নেই। কত দিন আর ব্রিটিশকে দোষ দেওয়া হবে? বিতর্কে না জড়িয়ে কালজয়ী সত্যকে তুলে ধরতে হবে।’’
তবে কোনও একটি দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে যে যথার্থ ইতিহাস রচনা হতে পারে না তা জানিয়েছেন রোমিলা। তাঁর কথায়, ‘‘জাতীয়তাবাদ হল সমাজের সামূহিক সত্ত্বা-র (কালেক্টিভ সেল্ফ) প্রতিচ্ছবি। তার মধ্যে সমস্ত নাগরিক সমান অধিকার পাবে। কিন্তু জাতি, ধর্ম, ভাষার মতো কোনও একটা বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে জাতীয়তাবাদ নির্ধারিত হলে তা হয়ে যায় সংখ্যাগুরুর আধিপত্যবাদ।’’