Bangladesh Protest

ঢাকার পরিস্থিতির দিকে নজর, ভারত-বিরোধী সুর কমানোই চ্যালেঞ্জ দিল্লির

এমন নয় যে এমনিতে প্রতিবেশী বলয়ে নিশ্চিন্তই আছে ভারত, একমাত্র ঢাকার মানুষই বেসুরো গাইছেন। মলদ্বীপ থেকে নেপাল, নয়াদিল্লির জনপ্রিয়তা ক্রমহ্রাসমান। তবে কূটনৈতিক শিবিরের মতে, বাংলাদেশের পরিস্থিতি ভিন্ন।

Advertisement

অগ্নি রায়

নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ২২ জুলাই ২০২৪ ০৭:৪৫
Share:

বাংলাদেশ জুড়ে যখন হিংসার ছবি। —ফাইল ছবি।

কোটা সংস্কার আন্দোলনে বাংলাদেশ জুড়ে যখন হিংসা তুঙ্গে, বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়ালকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, নয়াদিল্লি বিষয়টি নিয়ে কী ভাবছে। তিনি এক লাইনে জবাব দিয়েছিলেন, ‘‘এটি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়।’’

Advertisement

সত্যিই কি তাই? কূটনৈতিক মহল কিন্তু বলছে, ভারতের সঙ্গে দীর্ঘতম সীমান্ত ভাগ করে নেওয়া দেশে প্রবল রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং আইনশৃঙ্খলা ভেঙে পড়ার ঘটনায় সাউথ ব্লকের গভীর অস্বস্তি এবং উদ্বেগকেই আড়াল করতে চেয়েছেন রণধীর। কারণ এখন এ নিয়ে রা কাড়াও ভারতের পক্ষে বুমেরাংয়ের সমান। গত ছ’মাসেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশ জুড়ে ভারত-বিরোধিতার যে ঢেউ দেখা গিয়েছে, তা-ই নতুন মোড়কে ফিরে এসেছে এখন। ঢাকার রাজপথে গর্জন শোনা গিয়েছে, ‘ভারত যাদের মামাবাড়ি, বাংলা ছাড়ো তাড়াতাড়ি।’ ফিরে এসেছে ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাক, ‘ভারতীয় আগ্রাসনের’ বিরুদ্ধে, ‘ভারতের তাঁবেদার সরকার’ আওয়ামী লীগকে হটানোর ডাক। আর এ সবই ঘটেছে নয়াদিল্লির নাকের ডগায়।

এমন নয় যে এমনিতে প্রতিবেশী বলয়ে নিশ্চিন্তই আছে ভারত, একমাত্র ঢাকার মানুষই বেসুরো গাইছেন। মলদ্বীপ থেকে নেপাল, নয়াদিল্লির জনপ্রিয়তা ক্রমহ্রাসমান। তবে কূটনৈতিক শিবিরের মতে, বাংলাদেশের পরিস্থিতি ভিন্ন। কারণ, হাসিনা সরকারের সঙ্গে গত ১৫ বছর ‘সোনালি দৌত্য’ চালিয়ে গিয়েছে ইউপিএ এবং এনডিএ সরকার উভয়েই। তবু ভারত-বিরোধী ভাষ্যের এই প্রাবল্যের মুখে দাঁড়িয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনের পর বেশ কিছু প্রশ্ন মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে সাউথ ব্লকের অভ্যন্তরে। সূত্রের খবর, চেষ্টা চলছে, বিষয়গুলির দিকে বাড়তি নজর দিয়ে ক্ষত মেরামত করার।

Advertisement

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সরকারি কর্তার মতে, ‘‘বাংলাদেশে যেটা চলছে, সেটা মূলত ভারত-বিরোধী এক সামাজিক যুদ্ধ। এর মোকাবিলার প্রথম ধাপ হল, যে বিষয়গুলি নিয়ে নয়াদিল্লি-বিরোধী বয়ান তৈরি হচ্ছে, সেগুলির পাল্টা ভাষ্য তৈরি করা এবং প্রচারমাধ্যমকে কাজে লাগিয়ে যত দূর সম্ভব প্রকৃত তথ্য তুলে ধরার চেষ্টা করা। আপাতত ভারতের তরফ থেকে কোনও বয়ানই দেওয়া হয়নি সঙ্গত কারণে। প্রকাশ্যে হাসিনা সরকারের পাশে গিয়ে দাঁড়ালে (অর্থাৎ সে দেশের সেনার সঙ্গে সরাসরি সমন্বয় করলে) ছাত্রসমাজ তথা বাংলাদেশের নাগরিকদের মধ্যে ভুল বার্তা গিয়ে হিতে বিপরীত হতে পারে। তবে এই ভারত-বিরোধী আবেগ কমাতে বিভিন্ন মাধ্যমে তথ্য তুলে ধরার চেষ্টা করা হবে।’’

মোদী সরকারের ‘হিন্দুত্ব ভাষ্য’, বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের নিয়ে বিভিন্ন সময়ে শীর্ষ মন্ত্রী পর্যায় থেকে বিরূপ মন্তব্য, নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন, সার্বিক ভাবে এ দেশের সংখ্যালঘু বিরোধিতার রাজনৈতিক স্বর (যা নিয়ে বিরোধীরা অভিযোগ করেছেন বারবার) বাংলাদেশে হিন্দুদেরও কিছুটা চাপের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। মোদী, অমিত শাহের হিন্দুত্ব ভাষ্য যত কঠোর হয়েছে, বাংলাদেশে পরোক্ষ ভাবে সংখ্যালঘুদের উপর ক্ষোভ বেড়েছে— এই সমীকরণের কথা বারবারই বলেছেন দ্বিপাক্ষিক বিশেষজ্ঞরা। আজ এই আপৎকালীন পরিস্থিতিতেও বিষয়টি ফিরে আসছে, কিন্তু যার কোনও আশু সুরাহা প্রশাসনিক ভাবে কেউই দেখতে পাচ্ছেন না।

আরও একটি বিষয় নিজেদের সমীক্ষায় দেখছে কেন্দ্র— গত দশ বছরে অত্যন্ত কম সুদে যে বিপুল ঋণ দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশকে, তা সঠিক ভাবে সে দেশের মানুষের কাছে প্রচারিত হয়নি। অথচ ঢাকার পরিকাঠামো ক্ষেত্রে চিন যখনই যা করেছে, তা বহুল বিজ্ঞাপিত হয়েছে। যদিও চিনের সুদের হার ভারতের দেওয়া সুদের হারের থেকে অনেক গুণ চড়া। পাশাপাশি আর একটি দিকও উঠে আসছে পর্যালোচনায়। সুদ সস্তায় দিলেও ভারতে লাল ফিতের ফাঁস এতটাই প্রবল যে, তা প্রকল্পের দরজা পর্যন্ত পৌঁছতে সময় লাগছে অনেকটাই বেশি। সেই ক্ষোভ রাস্তায় গড়াতেই পারে।

এ ছাড়াও অবশ্যই যাবতীয় ভারত-বিরোধিতার পিছনে বরাবর যে নির্দিষ্ট নকশাটি কাজ করে, তা এ বারও আরও বেশি করে ক্রিয়াশীল বলে মনে করছে সাউথ ব্লক। পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের পাকিস্তানপন্থী দলগুলি এই কার্যকলাপের সঙ্গে এ বারে সরাসরি যুক্ত। বাংলাদেশের মাটিকে কাজে লাগিয়ে অতীতে বিএনপি জমানায় ইসলামাবাদ লাগাতার সন্ত্রাস পাচার করেছে ভারতে। বাংলাদেশের ভূকৌশলগত অবস্থানকে নাশকতার কাজে লাগিয়েছে আইএসআই। ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর, ভারতকে কথা দেন, বাংলাদেশের মাটিকে ভারত-বিরোধী সন্ত্রাসের কাজে ব্যবহার হতে দেওয়া হবে না। কিন্তু বাংলাদেশে ভারত-বিরোধিতার আবহাওয়া তৈরি করার সুযোগ পেলে আইএসআই ছেড়ে দেবে, এমন নয়। অন্য দিকে পরপর চার বার শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর বিএনপি-র ব্রিটেনে আত্মগোপন করে থাকা নেতারা বাংলাদেশ সরকারের উন্নয়নের মুখ্য শরিক ভারতকে নিশানা করছেন বলে দাবি করছে সাউথ ব্লক সূত্র। মলদ্বীপের প্রেসিডেন্ট মহম্মদ মুইজ্জুর ‘ভারত তাড়াও’ প্রচারের সময় থেকেই বাংলাদেশের বিএনপিপন্থী এবং ঐতিহ্যগত ভাবে মৌলবাদী অংশগুলি আরও চাঙ্গা হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।

ভারতের বাজারে পেঁয়াজের জোগানে সঙ্কট এবং তার জেরে দাম বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কায় মোদী সরকার রফতানিতে রাশ টেনেছিল। গত বছর থেকেই বাংলাদেশ এবং সংযুক্ত আরব আমিরশাহিকে পেঁয়াজ পাঠানো বন্ধ করে দেয় ভারত। বিষয়টি নিয়ে সরকারি স্তরে বারবারই আবেদন জানিয়েছেন শেখ হাসিনার মন্ত্রী এবং কর্তারা। সম্প্রতি বিষয়টি নিয়ে সে দেশে ভারত-বিদ্বেষের ঢেউ তৈরি হয়। ভারত হঠাৎ রফতানি বন্ধ করে দেওয়ায় বাংলাদেশের অসুবিধা হয়েছে ঠিকই। তখন কূটনৈতিক স্তরে আলোচনা এগোয় এই পরিস্থিতি এড়ানোর একটি মেকানিজম তৈরি করার ব্যাপারে। বাংলাদেশের এক কর্তা সে সময় বলেছিলেন, “পণ্যের আমদানি-রফতানির বিষয়কে কিছু মৌলবাদী রাজনীতির বিষয় করে তুলছে, এটা বন্ধ হওয়া প্রয়োজন। আমরা ভারতের সঙ্গে আলোচনার মধ্যে রয়েছি। ভারতের কাছে আমাদের অনুরোধ, পেঁয়াজ, চিনি, গমের মতো কিছু পণ্যের একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ যাতে প্রতি মরসুমেই বাংলাদেশে যাতে যায়, সেই মেকানিজম স্থির করা হোক। তা হলে আর কেউ এই নিয়ে রাজনীতি করতে পারবে না।” কিন্তু তার পর শেখ হাসিনা দু’বার ভারত সফর করে গেলেও কোনও মেকানিজম তৈরি করা সম্ভব হয়নি।

যদিও গত এপ্রিল মাসে নিজেদের খরিফ এবং রবিশস্য উৎপাদন কম হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশ-ভুটান-নেপাল-মরিশাসের মতো দেশগুলিতে তা রফতানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভারত। কিন্তু জুলাই মাসে এই ছাত্র আন্দোলনের মঞ্চ দেখিয়ে দিল, তাতে নয়াদিল্লি-বিরোধিতার আঁচ কমেনি। বরং এখনও ভারতীয় পণ্য বয়কটের আওয়াজ উঠছে।

সব মিলিয়ে শীর্ষ নেতৃত্ব স্তরে ‘সোনালি অধ্যায়ের’ একটি ছবি দক্ষিণ এশিয়া দেখতে পেলেও, দু’দেশের মানুষের মধ্যে যোগাযোগ বিভিন্ন স্তরে আরও বাড়ানোর কথাই যে এ বার ভাবতে হবে, তা ঘরোয়া ভাবে স্বীকার করছে নয়াদিল্লি। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশি ছাত্রদের জন্য আরও বেশি স্কলারশিপ বাড়ানো, নজরদারি বহাল রেখে ভিসা আরও শিথিল করা, ভিসার আবেদন প্রক্রিয়া সহজ করার মতো বিষয়গুলিতে কত দূর এগোনো যায়, সে বিষয়ে ভাবনাচিন্তা শুরু হয়েছে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement