স্থানীয় ভাষায় ‘জো’ শব্দের অর্থ শীতল পাহাড়ি এলাকা। ‘মিজো’ হল সেই এলাকার বাসিন্দা। আর, সেই বাসিন্দাদের থাকার জায়গা হল ‘মিজোরাম’। উপজাতিদের ভাষায় ‘রাম’ শব্দের অর্থ দেশ। সাম্প্রতিক সমীক্ষা বলছে, ভারতের উত্তর-পূর্বের সাতসুন্দরী বা সেভেন সিস্টার্সের অন্যতম এই রাজ্য দেশের ছোট রাজ্যগুলির মধ্যে সবথেকে সুখী।
এই প্রথম বার দেশে সুখের সমীক্ষা চালানো হল। সব রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলকে নেওয়া হয়েছিল সমীক্ষার আওতায়। সুখের উপরে কোভিডের প্রভাব, জনতার উপরে নেতাদের প্রভাব আর আম জনতার সুখের চাবিকাঠি— এ সবই সমীক্ষায় যাচাই করা হয়েছে।
২০২০ সালের মার্চ থেকে জুলাই পর্যন্ত পুরোপুরি লকডাউন পর্বে সমীক্ষাটি চালানো হয়। ফলাফল সম্পাদনা করেছেন অধ্যাপক রাজেশ কে পিল্লনিয়া। সমীক্ষার ফলে সুখের শর্ত হিসেবে উঠে এসেছে বৈবাহিক অবস্থা, বয়স, শিক্ষা ও রোজগার। সমীক্ষায় উল্লেখযোগ্য ভাবে দেখা গিয়েছে, বিবাহিতরাই অবিবাহিতদের তুলনায় বেশি সুখী!
মিজো পাহাড়ে জনবসতির উল্লেখ পাওয়া যায় দেড় হাজার খ্রিস্টাব্দ থেকেই। ব্রিটিশ লেখকরা তাঁদের উল্লেখ করেছেন ‘কুকি’ বলে। ব্রিটিশ শাসনের আগে ছোট ছোট স্বশাসিত গ্রামে বিভক্ত ছিল মিজো-রা। প্রত্যেক গ্রামের শাসন চলত মোড়লের কথায়। সমাজের অভিজ্ঞ এবং প্রবীণ মানুষই মোড়ল হতেন। তবে প্রতিবেশী জনপদ এবং দেশের রাজাদের প্রভাব ছিল মোড়লদের শাসনে।
দীর্ঘদিন প্রতিরোধ করেও ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ শক্তির পদানত হতে বাধ্য হয় মিজো উপজাতি। ব্রিটিশ উপনিবেশের অংশ হওয়ার পরে মিজো পাহাড়ে মিশনারিদের প্রভাব বাড়ে। জনমানস ও সংস্কৃতিতে আমূল পরিবর্তন দেখা দেয়।
স্বাধীনতা লাভের পরে মিজো পাহাড় প্রথমে ছিল কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল। পরে ১৯৭২-এ এই ভূখণ্ডের নাম হয় মিজোরাম। ১৯৮৬ সালে তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকার এবং মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্ট বা এমএনএফ-এর মধ্যে স্বাক্ষরিত হয় মিজোরাম শান্তি চুক্তি। এরপর ১৯৮৭ তে ভারতের অঙ্গরাজ্য হিসেবে পরিচিত হয় মিজোরাম।
৮১৪২ বর্গমিটার আয়তনের মিজোরাম দেশের পঞ্চম ক্ষুদ্রতম রাজ্য। উত্তরদিকে একে ঘিরে আছে মণিপুর, অসম এবং ত্রিপুরা। দক্ষিণ দিকে মিজোরামের সীমানা বরাবর বিস্তৃত দুই পড়শি দেশ, মায়ানমার ও বাংলাদেশ। মিজো পাহাড়ের সর্বোচচ শৃঙ্গ ফংপুই লাং-কে (উচ্চতা ২১৫৭ মিটার) বলা হয় ‘নীলপাহাড়’ বা ‘ব্লু মাউন্টেন’।
নদী, পাহাড় ও বন্যপ্রাণীর জীববৈচিত্রে ভরপুর এই রাজ্যের ঠিক মাঝ বরাবর চলে গিয়েছে কর্কটক্রান্তি রেখা। কৃষিভিত্তিক অর্থনীতিপ্রধান এই রাজ্য অর্কিড উৎপাদনে অগ্রগণ্য।
অতীতে মিজো উপজাতির জনপ্রিয় সংস্কৃতি ছিল হেড হান্টিং বা শত্রুপক্ষের মাথা কেটে আনা। শিকার করা মাথা ছিল গৃহসজ্জার অন্যতম উপকরণ। যার সংগ্রহে যত কাটা মাথা, মিজো সমাজে সে ছিল তত বড় বীর। ব্রিটিশ শাসন থেকেই ‘হেড হান্টিং’ নিষিদ্ধ করা হয়। এখনও নিজেদের পার্বণে মানুষের কৃত্রিম মাথা উৎসর্গ করে দেবতাকে।
অতীতে পরাজিত বিপক্ষের মাথা শিকার করার মধ্য়ে উল্লাস খুঁজে পাওয়া এই জনপদই দেশের অন্যতম সুখী রাজ্য। বলছে, সমীক্ষার ফল। অথচ গত এক বছরে রাজ্যে অসন্তোষের কারণ কম নয়। নাগরিকত্ব আইন সংশোধনীর বিরুদ্ধে আন্দোলনে রাস্তায় নেমে প্রকাশ্যে ‘হ্যালো চায়না, বাই বাই ইন্ডিয়া’ স্লোগান-পোস্টার উঁচিয়ে মিছিল করেছেন মিজোরা।
নতুন সরকার এসে মদ্যপান ও মদ বিক্রি নিষিদ্ধ করায় হতাশ সুরাপ্রেমীরা। পরিবর্তে তাঁরা বেছে নিয়েছেন মাদক। প্রাণ যাচ্ছে অনেকের।
১৯৯০ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে রাজ্যে ২১,৫৩৮ জন এইচআইভিতে আক্রান্ত হয়েছেন। এডস রোগীর সংখ্যায় মিজোরাম দেশে শীর্ষস্থানে। মাঝেমধ্যেই ভূমিকম্প হচ্ছে মিজোরামের বিভিন্ন জেলায়। বিনিদ্র রাত কাটাচ্ছেন মানুষ। নামছে ধস।
ব্রু শরণার্থীদের নিয়ে বিবাদ-বিতর্ক চলছে বিস্তর। বৈষম্যের অভিযোগ তুলছেন চাকমারা। করোনায় আক্রান্ত হয়েছে রাজ্যের দেড় হাজারের বেশি মানুষ। তবে উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, ভারতের একমাত্র রাজ্য মিজোরাম যেখানে আজ পর্যন্ত করোনা কারও প্রাণ কাড়তে পারেনি।
প্রাকৃতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে এত সমস্যা ও প্রতিবন্ধকতার পরেও ভারতে প্রথম বার হওয়া সুখী রাজ্যের সমীক্ষায় ছোট রাজ্যগুলির তালিকায় শীর্ষস্থান মিজোরামের। প্রতিবেশী চিনের শাসানিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে, সুখী রাজ্যের প্রথম তিনে স্থান করে নিয়েছে অরুণাচলপ্রদেশও।
সুখী রাজ্যের তালিকায় একেবারে শেষে স্থান ওড়িশা, ছত্তীসগঢ়,হরিয়ানার। পশ্চিমবঙ্গ রয়েছে ২০ নম্বরে। দিল্লি ও মহারাষ্ট্রে সুখের উপরে কোভিডের প্রভাব পড়েছে সবথেকে বেশি।