প্রতীকী ছবি।
চল্লিশ বছর পরে বৃদ্ধির বদলে সঙ্কোচনের মুখ দেখতে চলেছে দেশের অর্থনীতি। বৃহস্পতিবার মোদী সরকারের জাতীয় পরিসংখ্যান দফতরের পূর্বাভাস, ২০২০-২১ সালে জিডিপি (দেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন) আগের বছরের তুলনায় সরাসরি কমে যেতে পারে ৭.৭%। শেষমেশ তা মিলে গেলে, স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে এই প্রথম শূন্যের এতখানি নীচে নেমে যাবে বৃদ্ধির হার। আশঙ্কা লক্ষ্যমাত্রার দ্বিগুণ রাজকোষ ঘাটতিরও।
সরকারি সূত্র ও অর্থনীতিবিদদের একাংশের মতে, এই পূর্বাভাস প্রত্যাশিত। কারণ, অর্থবর্ষের প্রথম তিন মাসে (এপ্রিল-জুনে) জিডিপি প্রায় ২৪% সঙ্কুচিত হওয়ার পরেই বোঝা গিয়েছিল যে, অর্থবর্ষ শেষে বৃদ্ধির হার থাকবে শূন্যের অনেক নীচে। কিন্তু অন্য পক্ষের মতে, দু’টি কারণে এই পরিসংখ্যান অর্থবহ। প্রথমত, অর্থনীতি দ্রুত ছন্দে ফিরছে বলে দাবি করার পরেও এতখানি সঙ্কোচনের সম্ভাবনা মেনে নিতে বাধ্য হল কেন্দ্র। আর দ্বিতীয়ত, অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে শুধু সস্তার ঋণে আস্থা না-রেখে সরকারি খরচের দাওয়াই কত জরুরি ছিল, তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখাল এই পূর্বাভাস। বাজেট প্রস্তুতি হিসেবে শুক্রবার অর্থনীতিবিদদের সঙ্গে বৈঠকে বসবেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। লক্ষ্য, বৃদ্ধির হার চাঙ্গা করার উপায় খোঁজা।
এর আগে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের পূর্বাভাস ছিল, কোভিড ও লকডাউনের ধাক্কায় বৃদ্ধির হার নেমে যাবে শূন্যের ৭.৫% নীচে। এ দিন স্পষ্ট, তার থেকেও বেশি সঙ্কোচনের আশঙ্কা করছে কেন্দ্র। তা-ও এটি প্রথম আগাম অনুমান। পরিসংখ্যান দফতর জানিয়েছে, কোভিডে তথ্য সংগ্রহে সমস্যা হয়েছে। তাই পরে পূর্বাভাস সংশোধিত হতে পারে। অর্থনীতিবিদদের একাংশের ধারণা, সঙ্কোচন আরও বেশি হবে। বিশ্ব ব্যাঙ্কের ধারণা, তা হবে ৯.৬%।
শেষ বার দেশে সঙ্কোচন হয়েছিল ১৯৭৯-৮০ সালে। দেশে খরা এবং ইরানে অস্থিরতার জেরে অশোধিত তেলের দামে অস্বাভাবিক বৃদ্ধি— এই দু’য়ের ধাক্কায় সে বছর ৫.২% সঙ্কোচন হয়েছিল। কোভিড ও লকডাউনের ধাক্কা আরও জোরালো।
আশার আলো শুধু কৃষি। দেড় মাস দিল্লির সীমানায় কৃষক-আন্দোলন চলছে। কিন্তু পূর্বাভাস অনুযায়ী, একমাত্র কৃষিতেই চলতি বছরে বৃদ্ধি দেখা যাবে (৩.৪%)। দীর্ঘ দিন কল-কারখানা বন্ধ থাকায় ও বাজারে কেনাকাটার অভাবে উৎপাদন শিল্প সঙ্কুচিত হবে ৯.৪%। পরিষেবায় সঙ্কোচন প্রায় ২১.৪%।
জিডিপি কমলে, তার তুলনায় রাজকোষ ঘাটতি এমনিতেই বেড়ে যায়। তার উপরে লকডাউনে কেন্দ্রের রাজস্ব আদায় কমেছে। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ঋণের বোঝা। অর্থ মন্ত্রক সূত্রের খবর, চলতি বছরে রাজকোষ ঘাটতি ৭ শতাংশে পৌঁছতে পারে। যা লক্ষ্যমাত্রার (৩.৫%) দ্বিগুণ। পূর্বাভাস মেনে ৭.৭% সঙ্কোচন হলে, ৮ শতাংশের কাছাকাছি ঘাটতির আশঙ্কাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না অর্থ মন্ত্রকের কর্তারা।
মার্চের শেষে সারা দেশে লকডাউন জারির পরে এপ্রিল-জুনে জিডিপি প্রায় ২৪ শতাংশ সঙ্কুচিত হয়েছিল। জুলাই-সেপ্টেম্বরে তা ৭.৫ শতাংশে নেমে আসে। সেই হিসেবে সারা বছরে ৭.৫ শতাংশ সঙ্কোচন অপ্রত্যাশিত নয় বলেই অনেকের মত। অর্থ মন্ত্রকের বক্তব্য, বিভিন্ন মাপকাঠিতে স্পষ্ট যে, গত কয়েক মাসে অর্থনীতির সার্বিক উন্নতি হচ্ছে। কিন্তু বাজারে চাহিদা ফিরিয়ে অর্থনীতিকে পুরোদস্তুর চাঙ্গা করতে আরও দাওয়াইয়ের প্রয়োজনীয়তা এই পূর্বাভাসে স্পষ্ট।
বণিকসভা সিআইআইয়ের ডিরেক্টর জেনারেল চন্দ্রজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘সরকারি খরচ, ভাল বর্ষার দৌলতে কৃষিতে ভাল ফলের দরুন সঙ্কোচন আগের আশঙ্কার তুলনায় কম। গত কয়েক মাসে অর্থনীতি অনেকটাই ঘুরে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু তাতে আরও জল-সার দিতে হবে। বিশেষত বাজারে কেনাকাটা ধরে রাখতে দাওয়াই দরকার।’’ অর্থনীতিবিদদের ব্যাখ্যা, বহু দিন বাজার-হাট বন্ধ থাকায় ও উৎসবের মরসুমে হালে কেনাকাটা বেড়েছে। কিন্তু তা ধরে রাখতে সরকারের টাকা ঢালা জরুরি।
প্রশ্ন হল, টাকা আসবে কোথা থেকে? রাজকোষ ঘাটতি বৃদ্ধির সম্ভাবনা মেনে অর্থ মন্ত্রক সূত্র বলছে, এপ্রিল-জুনেই রাজস্ব আদায়ে যে পরিমাণ লোকসান হয়েছে, তা পরের ন’মাসেও পূরণ করা শক্ত। কর বাবদ আয়ে ২৪ লক্ষ কোটি টাকারও বেশি লক্ষ্য রাখা হয়েছিল। বাস্তবে তা ৪-৫ লক্ষ কোটি টাকা কম হতে পারে। ২.১ লক্ষ কোটির লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ১.৫ লক্ষ কোটি টাকা পর্যন্ত কম আয় হতে পারে বিলগ্নিকরণ থেকেও। ফলে এখানেও শাঁখের করাতে কেন্দ্র।