লাদাখে চিনের অভিযান স্বতঃস্ফূর্ত কোনও ঘটনা নয়। মনে করছে কূটনৈতিক শিবির। ছবি: সংগৃহীত।
পঁয়তাল্লিশ বছর পর ভারত-চিন সীমান্ত রক্তাক্ত করে তোলার পিছনে বেজিংয়ের পক্ষ থেকে কোনও একটি নয়, বহু কারণের সমাবেশ রয়েছে বলেই মনে করছেন কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞরা। দক্ষিণ এবং দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় ভূখণ্ডের অধিকার এবং বাণিজ্যিক ও রণকৌশলগত ক্ষেত্রে চিনের একাধিপত্য স্থাপনের যে বৃহৎ লক্ষ্য, এটি তারই অংশ বলে মনে করা হচ্ছে।
কূটনৈতিক শিবিরের মতে, অনেক দিন ধরে ঠান্ডা মাথায় পরিকল্পনা করে লাদাখে এগিয়েছে বেজিং। এখানকার অভিযান স্বতঃস্ফূর্ত কোনও ঘটনা নয়। গোটা শীতকাল জুড়ে চিন প্রস্তুতি নিয়েছে এবং ঠান্ডা কমার পরই তারা আক্রমণাত্মক ভূমিকা নিতে শুরু করেছে। এর পিছনে প্রত্যক্ষ কারণ দু’টি। এক, লাদাখের গালওয়ান উপত্যকা সংলগ্ন প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখাকে সুবিধাজনক অবস্থানে নিয়ে যাওয়া। অর্থাৎ, ওই ভূখণ্ডের একটি অংশে নিজেদের আধিপত্য স্থাপন করা। দুই, লে থেকে কারাকোরাম পাস পর্যন্ত দীর্ঘ রাস্তা এবং পরিকাঠামো তৈরির কাজ বন্ধ রাখতে ভারতের উপর চাপ তৈরি করা। বেজিং-এর ঘাড়ের কাছে ভারত যাতে নিঃশ্বাস ফেলতে না পারে, তা নিশ্চিত করতে চাওয়া।
চিনের বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্রই হোন বা লাল ফৌজের ওয়েস্টার্ন কমান্ড— গত কালের পর থেকে তাঁদের সবারই বক্তব্য, ‘‘গালওয়ান নদী উপত্যকার সার্বভৌমত্ব বরাবরই আমাদের ছিল।’’ কূটনীতিকদের বক্তব্য, এটাই চিনের বরাবরের কৌশল। বিতর্কিত অঞ্চলে অগ্রসর হয়ে কিছু দিন থাবা গেড়ে বসে থাকা, তার পর সেখানে নিজেদের দাবি প্রতিষ্ঠিত করে ফেলা।
যে সব চুক্তি লঙ্ঘন
• ১৯৯৩-এর চুক্তি অনুসারে দু’পাশের কেউই প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা (এলএসি) টপকে অন্য পারে যেতে পারবে না। এক দেশের সেনা অন্য পারে চলে গেলে তাঁকে সতর্ক করে অবিলম্বে ফেরত পাঠানো হবে।
• ১৯৯৬-এর চুক্তি অনুসারে এলএসি নিয়ে মতান্তরের কারণে, সীমান্ত সেনারা পরস্পরের মুখোমুখি হয়ে গেলে তাদের সংযম দেখাতে হবে। উত্তেজনা প্রশমনে ব্যবস্থা নিতে আলোচনায় বসতে হবে।
• এলএসি নিয়ে যেখানে মতৈক্য নেই, ২০১৩-র চুক্তি অনুসারে সেখানে এক পক্ষ কখনওই অন্য পক্ষের টহলদার সেনাকে অনুসরণ করবে না।
প্রাক্তন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিবশঙ্কর মেননের মতে, ২০১৩ সালের দেবসাং অথবা ২০১৭ সালের ডোকলামে চিনা অনুপ্রবেশের তুলনায় লাদাখের ঘটনা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ এবং আশঙ্কাজনক। তাঁর কথায়, “১৯৬২ সালের পর থেকে গালওয়ান উপত্যকার অবস্থানগত কোনও পরিবর্তন হয়নি। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, হাজার হাজার সেনা ভারী অস্ত্র সমেত ভারতীয় ভূখণ্ডের ভিতরে ঢুকে পড়েছে। তার মানে ভূখণ্ডের সীমা বদলাতে চাইছে চিন।’’ তাঁর মতে এটিও চিনের দু পা এগিয়ে এক পা পিছোনোর চিরাচরিত রণনীতিরই উদাহরণ। অর্থাৎ পরে এক পা পিছিয়ে তারা ভারতকে দেখাবে যে, তারা ছাড় দিল। আসলে কিন্তু এক পা এগিয়েই রাখছে তারা।
আরও পড়ুন: লাদাখে সেনা বাড়াচ্ছে দুই দেশই || আমরা জবাব দিতে তৈরি: মোদী
আরও পড়ুন: উত্তর চান বিরোধীরা, কাল সর্বদল প্রধানমন্ত্রীর
আমেরিকায় ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত রণেন সেনের মতে, “গালওয়ান উপত্যকা চিনের কাছে খুবই স্পর্শকাতর। মধ্য এশিয়ার সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে, পাকিস্তানের সঙ্গে প্রস্তাবিত বাণিজ্যিক করিডর বা সিপিইসি গঠনে পূর্ব লাদাখের ওই ভূখণ্ড বেজিংয়ের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। আকসাই চিনের বিতর্কিত ভূভাগ এবং ১৯৬২-র পর পাকিস্তানের কাছ থেকে নেওয়া জম্মু-কাশ্মীরের জমিও একটা বড় ফ্যাক্টর। ভারতীয় পরিকাঠামোর বাড়বৃদ্ধি সেখানে তাদের কাছে কাঁটার মতো।’’
কূটনৈতিক সূত্রের বক্তব্য, কোভিড নিয়ে বিশ্বজোড়া সমালোচনার মুখে পড়া শি চিনফিং নিজের দেশেও প্রবল ভাবে সমালোচিত হচ্ছেন। ভারতের সঙ্গে সীমান্তে গরম হাওয়া বইয়ে দিতে পারলে ঘরোয়া ক্ষেত্রে কিছুটা দৃষ্টি ঘোরানো সম্ভব হবে, এটাও তাদের হিসেবের মধ্যে রয়েছে। অন্যান্য বহু দেশের মতো ভারতও চায়, করোনা সংক্রমণের উৎস নিয়ে নিরপেক্ষ তদন্ত হোক। মুখে করোনাকে চিনা ভাইরাস না বললেও চিনপন্থী বলে ‘পরিচিত’ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আমূল সংস্কারের পক্ষে বার্তা দিয়ে সাউথ ব্লক তার মন বুঝিয়ে দিয়েছে। কোভিড পরবর্তী নতুন বিশ্ব-ব্যবস্থায় আমেরিকার কৌশলগত মিত্র হিসেবেও ভারতকে চাপে রাখতে তৎপর বেজিং।
এ ছাড়া তিব্বত এবং দলাই লামাকে কেন্দ্র করে পুরনো বৈরিতা তো সর্বদাই রয়েছে বলে মনে করছেন চিন বিশেষজ্ঞরা। চিনা কর্তারা সম্প্রতি ধারাবাহিক ভাবে বলে চলেছেন যে, পরের দলাই লামা বাছার ক্ষেত্রে ভারত যেন পথ রোধ না করে। ভারতকে চাপে রাখাটা সে দিক থেকেও দরকার মনে করেছে চিন।