বেজিংয়ের দিকে বাতিলের ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া জারি রেখেছে মোদী সরকার।
পণ্য ও পরিষেবা নিষিদ্ধ। বরাত বাতিল। আর আমদানিতে কড়াকড়ি। আপাতত এই ‘আর্থিক ত্রিশূলে’ বিঁধেই বেজিংকে বার্তা দিতে চাইছে দিল্লি।
টিকটক-সহ ৫৯টি চিনা মোবাইল অ্যাপ বাতিলের ঘোষণা ঘিরে তরজার পারদ চড়ছে ইতিমধ্যেই। বুধবার তা আরও উস্কে দিয়ে বিজেপি নেতা অমিত মালব্যর টুইট, “চিনা সোশ্যাল মিডিয়া উইবো ছাড়লেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। বার্তা স্পষ্ট, লাল দাগ (ধৈর্যের সীমা) পেরোলে, তার ফলও ভুগতে হবে। সীমান্তে যা শুরু হয়েছিল, তা ইতিমধ্যেই বহু দিকে ডালপালা ছড়িয়েছে। এবং হয়তো এটা নেহাতই শুরু…”
এতটা চোখা ‘যুদ্ধং দেহি’ মেজাজ না-দেখালেও, বেজিংয়ের দিকে বাতিলের ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া জারি রেখেছে মোদী সরকার। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী নিতিন গডকড়ী জানিয়েছেন, ভারতের কোনও সড়ক নির্মাণ প্রকল্পে দরপত্রই দিতে পারবে না চিনা সংস্থা। এমনকি এ দেশের কোনও সংস্থার সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেও নয়। নতুন প্রকল্পে শামিল হতে দেওয়ার তো প্রশ্নই নেই, প্রয়োজনে খতিয়ে দেখা হবে পুরনো বরাতও। নতুন করে দরপত্র চাওয়া হতে পারে সে ক্ষেত্রে। মন্ত্রীর দাবি, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বদলানো হচ্ছে ওই সমস্ত টেন্ডারে যোগ দেওয়ার আর্থিক এবং প্রযুক্তিগত শর্ত। যাতে নিজের জোরেই সেই বরাত হাসিল করতে পারে বিভিন্ন ভারতীয় সংস্থা। গডকড়ী জানিয়েছেন, ছোট ও মাঝারি শিল্পেও চিনা সংস্থাগুলিকে ঢুকতে দেওয়া হবে না।
আরও পড়ুন: কাশ্মীরে গুলি-যুদ্ধের মধ্যে নাতিকে বাঁচিয়ে নিহত দাদু
তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদ আবার ডাক দিয়েছেন উদ্ভাবনী কাজের অ্যাপ (মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন) তৈরির। চিনা অ্যাপ নিষিদ্ধ করার পরে যা তাৎপর্যপূর্ণ। তাঁর দাবি, বিদেশি অ্যাপের উপরে নির্ভরতা বন্ধ হওয়া জরুরি। বরং ওই সমস্ত অ্যাপ সরে যাওয়ার সুযোগে ফাঁকা হওয়া বাজার ধরতে এ দেশের স্টার্ট-আপগুলিকে এগিয়ে আসতে বলেছেন তিনি। দাবি করেছেন, এই খালি বাজার বিপুল সম্ভাবনার দরজা খুলে দেবে তাদের জন্য।
রেল মন্ত্রক জানিয়েছে, একটি চিনা সংস্থা বাড়তি সুবিধা পাওয়ার কারণে থার্মাল ক্যামেরা কেনার টেন্ডার বাতিল করেছে তারা। সংবাদ সংস্থা পিটিআইয়ের খবর অনুযায়ী, টেলিকম দফতর কোনও চিনা সংস্থাকে বরাত না-দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরে ৪জি-পরিকাঠামো গড়ার উপকরণ কেনার টেন্ডার বাতিলের পথে হাঁটছে বিএসএনএল-ও।
আরও পড়ুন: সীমান্তে শক্তি বাড়াচ্ছে চিন, দীর্ঘমেয়াদি সঙ্ঘাতের জন্য প্রস্তুতি ভারতেরও
চিনের বিরুদ্ধে মোদী সরকারের এই আক্রমণাত্মক আর্থিক নীতিতে এক দিকে যেমন দেশীয় শিল্পমহলের একাংশের মধ্যে বাড়তি বরাত পাওয়ার আশা দানা বাঁধছে, তেমনই বইছে আশঙ্কার চোরা স্রোত। যেমন প্রশ্ন উঠছে, শুধু দেশীয় সংস্থাকে দিয়ে হাইওয়ে তৈরি করাতে গিয়ে প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ এবং গুণমানের সঙ্গে আপোস করতে হবে না তো? বরাত পাবে না তো শুধু গুটিকয় সংস্থা?
যে স্টার্ট-আপকে নিত্যনতুন অ্যাপ তৈরির ডাক দিচ্ছেন মন্ত্রী, তাদের প্রথম সারির অনেকের পেটেই তো বিনিয়োগ ঠাসা। গাড়ি বুক করার ওলা, নেটে টাকা মেটানোর পেটিএম, বাড়িতে বসে খাবারের বরাত দেওয়ার জোম্যাটো কিংবা সুইগি, মাসকাবারির ফর্দ ধরানো বিগ বাস্কেট কিংবা ফ্লিপকার্ট, বাচ্চাদের পড়ার অ্যাপ বাইজ়ু’স থেকে শুরু করে হোটেল বুকিংয়ের মেক মাই ট্রিপ— সবেতে চিনা সংস্থার মোটা লগ্নি। চিন প্রত্যাঘাতের পথে হাঁটলে, তাদের বেকায়দায় পড়তে হবে না তো?
একই আশঙ্কা বিভিন্ন ভারী যন্ত্র, গাড়ি ও বৈদ্যুতিন পণ্যের যন্ত্রাংশ, বস্ত্র শিল্প ও ওষুধের কাঁচামাল ঘিরে। বন্দরে চিনা পণ্যকে ‘বাড়তি খাতিরের’ জন্য যে উদ্বেগ এ দেশের শিল্পমহল ইতিমধ্যেই প্রকাশ করেছে, যদি তার বদলা নিতে চড়া শুল্ক চাপায় চিন? সে ক্ষেত্রে দেশীয় শিল্পেরই সমস্যা বাড়বে কি?
এরই মধ্যে অবশ্য এ দিন ভারতীয় কর্মীদের চিঠিতে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করেছে সদ্য বাতিল হওয়া অ্যাপ টিকটক। সিইও কেভিন মেয়ারের দাবি, ভারতীয় গ্রাহক এবং কর্মীদের আবার ভাল অভিজ্ঞতা ফিরিয়ে দিতে সমস্ত রকম চেষ্টা করছে তারা। উল্টো দিকে, ই-কমার্স সাইটগুলিতে বিক্রি হওয়া পণ্যের উৎপাদনস্থল জানানোর যে বাধ্যবাধকতা সরকার সম্প্রতি চাপিয়েছে, সে বিষয়ে কেন্দ্রের অবস্থান জানতে চেয়েছে দিল্লি হাইকোর্ট।