হবে প্লেনামও

বিদ্রোহের মুখে দলিল ফেরাতে হল কারাটকে

সীতারাম ইয়েচুরির আপত্তিতে নিজের রাজনৈতিক রণকৌশলের দলিল প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হলেন প্রকাশ কারাট! পার্টি কংগ্রেসের জন্য সাধারণ সম্পাদক কারাটের নেতৃত্বে সিপিএম পলিটব্যুরোর তৈরি রাজনৈতিক ও কৌশলগল লাইনের পর্যালোচনার খসড়া রিপোর্ট পাশই হল না কেন্দ্রীয় কমিটিতে! কারাটদের ওই দলিলের পাল্টা দলিল পেশ করেন ইয়েচুরি।

Advertisement

প্রেমাংশু চৌধুরী

নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ৩০ অক্টোবর ২০১৪ ০৩:১৬
Share:

সীতারাম ইয়েচুরির আপত্তিতে নিজের রাজনৈতিক রণকৌশলের দলিল প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হলেন প্রকাশ কারাট!

Advertisement

পার্টি কংগ্রেসের জন্য সাধারণ সম্পাদক কারাটের নেতৃত্বে সিপিএম পলিটব্যুরোর তৈরি রাজনৈতিক ও কৌশলগল লাইনের পর্যালোচনার খসড়া রিপোর্ট পাশই হল না কেন্দ্রীয় কমিটিতে! কারাটদের ওই দলিলের পাল্টা দলিল পেশ করেন ইয়েচুরি। তাঁর বিদ্রোহ এবং কেন্দ্রীয় কমিটির বড় অংশের মনোভাব বুঝে ‘অফিসিয়াল’ দলিল প্রত্যাহার করে নতুন রিপোর্ট তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়েছেন কারাট। পার্টি কংগ্রেসের আগে সিপিএমে এমন ঘটনা স্মরণযোগ্য কালে নজিরবিহীন। স্বাভাবিক ভাবেই একে দলে ইয়েচুরির ‘নৈতিক জয়’ হিসাবেই দেখা হচ্ছে।

একই সঙ্গে কেন্দ্রীয় কমিটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে, পার্টি কংগ্রেসের পরে সাংগঠনিক বিষয়ে প্লেনাম ডাকা হবে। সম্মেলনের পরেই ১৯৭৯ সালে সালকিয়া প্লেনাম হয়। কিন্তু সেই সিদ্ধান্ত হয়েছিল পার্টি কংগ্রেসের মঞ্চেই। পার্টি কংগ্রেসের আগেই এ ভাবে প্লেনাম ডেকে রাখার সিদ্ধান্তও অভূতপূর্ব! দলের পলিটব্যুরোর এক সদস্যের কথায়, “কৌশলগত লাইন পর্যালোচনার দলিল নিয়ে যে ঘটনা ঘটল, তার পরে সাধারণ সম্পাদক হওয়ার লড়াই স্বভাবতই জমে উঠবে! পার্টি কংগ্রেসে যিনি সাধারণ সম্পাদক হিসাবে দায়িত্ব নেবেন, তিনি যাতে নিজের মতো করে সংগঠন নিয়ে ভাবতে পারেন, তার জন্যই আলাদা করে প্লেনামের সিদ্ধান্ত।”

Advertisement

বিতর্কে তাঁদের জয়-পরাজয়ের প্রশ্ন উড়িয়ে কারাট আজ বলেন, “দলে প্রত্যেকের মত জানানোর স্বাধীনতা রয়েছে। পার্টি কংগ্রেসের আগে রাজনৈতিক দলিল নিয়ে এমন বিতর্ক হয়েই থাকে।” তাঁর জমানার দিকে আঙুল ওঠা নিয়েও কারাটের যুক্তি, “কোনও ব্যক্তির প্রশ্ন নেই। সিপিএম পার্টিতে সাধারণ সম্পাদক পার্টি কংগ্রেসে গৃহীত লাইন মেনেই কাজ করেন।”

আপাতত সিদ্ধান্ত হয়েছে, ইয়েচুরির আপত্তি মেনে ১৯৭৮ সালে জালন্ধরে কংগ্রেস-বিরোধী মহাজোট তৈরির লাইন ঠিক ছিল না ভুল, সেই বিচারে যাবে না পলিটব্যুরো। নতুন করে রাজনৈতিক রণকৌশলের দলিল লেখারও সিদ্ধান্ত নিয়েছে পলিটব্যুরো। যদিও ইয়েচুরি শিবিরের এক কেন্দ্রীয় নেতা বলছেন, “আগের দলিলটা যাঁরা বানিয়েছিলেন, তাঁরাই আবার নতুন রিপোর্ট লিখবেন। পুরনো তত্ত্ব নতুন কৌশলে ফিরে আসে কি না, সে দিকেও নজর রাখতে হবে!” আগামী জানুয়ারিতে ফের কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে পার্টি কংগ্রেসের খসড়া রাজনৈতিক প্রস্তাব এবং নবরূপে রাজনৈতিক কৌশলের পর্যালোচনা রিপোর্ট আলোচনার জন্য পেশ হবে।

দলে বিতর্কের জেরে সিপিএম এখন যে লাইনে এগোতে চাইছে, তাতে ভবিষ্যতে ‘তৃতীয় ফ্রন্ট’ তৈরির চেষ্টা হবে না। জাতীয় স্তর থেকে আঞ্চলিক দলগুলির সঙ্গে কোনও রকম নির্বাচনী সমঝোতা হবে না। কোনও রাজ্য নেতৃত্বকেও আঞ্চলিক দলের সঙ্গে সমঝোতায় যাওয়ার জন্য কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব চাপ দেবেন না। তবে আঞ্চলিক দলগুলির সঙ্গে মিলে বিষয়ভিত্তিক আন্দোলনের দরজা খোলা রাখা হচ্ছে। ফলে, জাতীয় রাজনীতি থেকে বামেদের ‘তৃতীয় ফ্রন্ট’ কার্যত ইতিহাস হয়ে যাচ্ছে। এখন থেকে আন্দোলনের জন্য বাম গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট গড়ে তোলাই প্রাধান্য পাবে। আগামী ১ নভেম্বর দিল্লিতে চার বাম দলের সঙ্গে সিপিআই (এম-এল) লিবারেশন এবং এসইউসি-র বৈঠক থেকে যার প্রস্তুতি শুরু হবে। কংগ্রেসের প্রশ্নেও একই রণকৌশল নেওয়া হচ্ছে। কারাটের কথায়, “জাতীয় স্তরে বা রাজ্য স্তরে, এমনকী পশ্চিমবঙ্গেও কংগ্রেসের সঙ্গে কোনও নির্বাচনী সমঝোতায় আমরা যাব না। এ নিয়ে দলে কোনও বিতর্ক নেই, আলোচনাও নেই।” ইয়েচুরির যুক্তি ছিল, কেন্দ্রে মোদী সরকার ক্ষমতায় আসার পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গেও যে ভাবে বিজেপি মাথা তুলতে চাইছে, তাতে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াইকেও লক্ষ্য করা হোক। পশ্চিমবঙ্গের নেতাদের একাংশও তৃণমূল-বিরোধী আন্দোলনে কংগ্রেসের সঙ্গে যৌথ মঞ্চ গড়ে তোলার পক্ষে। কারাট কংগ্রেসের সঙ্গে নির্বাচনী সমঝোতার সম্ভাবনা উড়িয়ে দিলেও সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে বা সাধারণ মানুষের সমস্যা নিয়ে কংগ্রেসের সঙ্গে আন্দোলনে যাওয়ার সম্ভাবনা কিন্তু উড়িয়ে দেননি। তবে পলিটব্যুরোর এক নেতার যুক্তি, “ভবিষ্যতে রাজ্য স্তরে কোথাও কংগ্রেস বা আঞ্চলিক দলের সঙ্গে বোঝাপড়ায় যাওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হলে দেখা যাবে। ভবিষ্যতে আর কখনও হবে না, এমন কিছু বলা হচ্ছে না।” কেন্দ্রীয় কমিটির একটা বড় অংশের মত ছিল, দলের নিজস্ব সাংগঠনিক শক্তিই যেখানে দুর্বল হয়ে আসছে, সেখানে রাজনৈতিক রণকৌশল নিয়ে এত মাথা ঘামিয়ে লাভ কী? সাংগঠনিক খুঁটিনাটি নিয়ে আলোচনার জন্যই বিশাখাপত্তমে পার্টি কংগ্রেসের পরে পৃথক প্লেনাম ডাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন কারাট। ৩৫ বছর আগে সালকিয়ার মতো এই প্লেনামেরও মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হবে, পার্টির নিজস্ব শক্তি কেন বাড়ছে না?

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement