ইলতিজ়া মুফতি। ছবি: পিটিআই।
‘দাদু’ ছিলেন বেজায় গপ্পে। আড্ডার সময় ঠোঁটে জ্বলন্ত সিগারেট, সাংবাদিক সম্মেলনের পর অভিজ্ঞতা হয়েছে একাধিক বার তাঁর সঙ্গে বসার। চঞ্চল স্বরে আমাদেরই প্রশ্ন করতেন, তা হলে কী হচ্ছে? ‘মা’ বরাবরই পাথরপ্রতিমা। পুরনো সংসদ ভবনে একটি থামের আড়ালের আসনে তাঁকে দেখে গিয়েছি বরাবর। করিডরে সচরাচর প্রশ্ন এড়িয়েই যেতেন। এ বার উইলো আর চিনারের অরণ্য পেরিয়ে কাঠের বাড়ির গ্রামে ‘মেয়ে’কে দেখলাম প্রবল প্রাণশক্তিতে টগবগ করতে। দৌড়চ্ছেন ঝড়ের বেগে। কথা বলছেন বিদ্যুৎগতিতে।
“আপনাকে কি আমি সময় দিয়েছিলাম? দিইনি তো? তা হলে এখন কী ভাবে সাক্ষাৎকার দেওয়া সম্ভব!” প্রথম সাক্ষাতেই ঝাঁঝিয়ে উঠলেন মেয়ে ইলতিজ়া মুফতি। যিনি একটু পরই কাঠের বাড়িটির দালানে দাঁড়িয়ে বেশ কিছু ক্ষণ কথা বলবেন কাশ্মীর নিয়ে। যিনি মা মেহবুবা মুফতি এবং দাদু দেশের প্রাক্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তথা কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী মুফতি মহম্মদ সঈদের রাজনৈতিক উত্তরাধিকার নিয়ে চষে ফেলেছেন নিজের বিজবেহরা নির্বাচনী ক্ষেত্র তথা গোটা দক্ষিণ কাশ্মীরই। এই প্রথম পিডিপি-র হয়ে জম্মু ও কাশ্মীরের বিধানসভা ভোটে লড়াই করছেন মেহবুবা-কন্যা।
কাশ্মীরের প্রাচীনতম চিনার গাছের গেরস্থালি এই বিজবেহরা অনন্তনাগ জেলায়, যা পিডিপি-র দুর্গই বলা চলে। এ বারের ভোটে মোট ৯০টি আসনের মধ্যে যে ক’টি পেতে পারে পিডিপি তা আসবে দক্ষিণ কাশ্মীর থেকেই, এমনই মনে করছে স্থানীয় মহল। প্রথমেই প্রচারে গিয়ে যা স্পষ্ট করছেন ইলতিজ়া, তা হল রাজনৈতিক উত্তরাধিকারের বোঝাটাকে ঘাড় থেকে নামিয়ে রাখা। কৌশল হিসেবে যা মন্দ নয়। যাঁরা বংশানুক্রমে মুফতি মহম্মদ সঈদ পরিবারের অনুগামী, তাঁদের আনুগত্য এমনিতেই পাচ্ছেন মেহবুবা-কন্যা। কিন্তু একেবারে নতুন ভোটার যাঁরা, যাঁদের এক চোখে স্বপ্ন, অন্য চোখে হতাশা— তাঁরা এই রাজা-উজিরের গল্প শুনতে যে মোটেই আগ্রহী নন, সেটা নিজের তারুণ্যের শক্তিতে ধরে ফেলতে পেরেছেন ইলতিজ়া। বুঝেছেন, হাতে গরম ফলাফল চায় যুবা শক্তি, কাজ চায়, প্রমাণ ছাড়াই দেশদ্রোহের অভিযোগে বন্দি অসংখ্য মানুষের মুক্তি চায়, আরব দেশে গিয়ে হোটেলে বাসন মাজতে যাঁরা বাধ্য হচ্ছেন, পেট চালাতে তাঁরা ফিরে আসতে চান।
“এই এলাকা আমার নিজের ঘর। অল্পবয়সি মেয়েরা যে ভাবে আমায় সমস্ত মহল্লায় অভ্যর্থনা জানাচ্ছেন, আমি অভিভূত,” বলছেন ইলতিজ়া। তাঁর এই রাজনৈতিক লড়াইয়ে মায়ের ভূমিকা কী? “আমি চাই, আমার নিজের পরিচয়েই মানুষ আমাকে জানুন, মায়ের বা দাদুর পরিচয়ে নয়। আমি কখনওই চাইনি আমাকে মায়ের মতো দেখতে হোক অথবা তাঁর একগুঁয়ে মনোভাবও আমার উপর বর্তাক। আমি অনেকটাই কৌশলী, মা বেশি আবেগে চলেন।” অবশ্য এ কথাও বলছেন যে, তাঁর মা এবং দাদুর বেশ কিছু স্বভাবের সংমিশ্রণও ঘটেছে তাঁর মধ্যে।
ব্রিটেনের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আন্তর্জাতিক সম্পর্কে স্নাতকোত্তর। এর পর লন্ডনে ভারতীয় দূতাবাসে প্রশাসনিক অফিসার হিসেবে কাজ করেছেন ৩৭ বছরের এই কন্যা। সেই আরামের জীবন ছেড়ে এখন কাশ্মীরের গ্রামে ঘুরছেন, জীবনের ঝুঁকি নিয়েই। তাঁর মতে “এখানে সব কিছু কবরের তলায় চলে গিয়েছে। কাশ্মীরে রাজনীতি করা মানে জ্বলন্ত কয়লার উপর মধ্যে দিয়ে হেঁটে যাওয়া।” বলছেন, “গত পাঁচ বছরে বিজেপি সরকার আমাদের চাকরি, জমি থেকে আমাদেরই সরাতে চেষ্টা করে গিয়েছে। কেন্দ্রের বিভিন্ন পদক্ষেপের জন্য কত মানুষ কাজ হারিয়েছেন, তার ইয়ত্তা নেই। হয়তো দশ বছর আগে কেউ সমাজমাধ্যমে কিছু পোস্ট করেছিলেন, সেই অপরাধে তাঁর কাজ তো যাচ্ছেই, বন্দি করেও রাখা হচ্ছে। ফলে এখানকার যুবা শক্তিহীন, আশাহীন, উদ্যমহীন এক পরিস্থিতির শিকার। মাদকের নেশা অতিমারির মতো ছড়াচ্ছে। অনেক মহিলাও প্রেসক্রিপশন দেখিয়ে ঘুমের বড়ি কিনছেন দুশ্চিন্তা রুখতে। আমার প্রচারের মূল কথা যুবাদের চাকরি দেওয়া, তাঁদের দক্ষতা বাড়ানোর জন্য প্রশিক্ষণের প্রতিশ্রুতি।”
এনসি-র সহ সভাপতি নেতা তথা রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লা সম্প্রতি তাঁর মাকে কটাক্ষ করে বলেছেন, মেহবুবা মুফতি জম্মু ও কাশ্মীরকে ধ্বংস করে দেওয়া ছাড়া কিছুই করেননি। মেয়ে বলছেন, “শুনলাম, ওমর খুবই চাপে রয়েছেন। একটু ভয়েও রয়েছেন হেরে যাওয়ার। ওঁর কথাকে এত গুরুত্ব দেওয়ার কিছু নেই!”
যে দোতলা বাড়ির দালানে দাঁড়িয়ে মহল্লা বৈঠক করে পরেরটার জন্য ছুটে গেলেন ইলতিজ়া, সেই বাড়ির সদস্যেরা গত ৪০ বছর ধরে পিডিপি-র সমর্থক। বাড়ির মালিক মাঝবয়সি আলতাফের কথায়, “মুফতি সাহেবই আমাদের প্রথম উন্নয়নের স্বাদ দিয়েছেন। আমাদের রক্তে পিডিপি-র প্রতি আনুগত্য গত চল্লিশ বছর ধরে।” সেটা বোঝা গেল আলতাফের মেয়ে ইরতিজ়াকে দেখে। যিনি কলেজ থেকে দু’টি পিরিয়ড-এর ফাঁকে চলে এসেছিলেন শুধুমাত্র ইলতিজ়াকে দেখার জন্য। “আমি ওঁর ফ্যান, ওঁর মতোই হতে চাই পড়াশুনো শেষ করে। আমাদের নামেও দেখুন কী মিল”, বলছেন কাশ্মীরি কন্যা।
নেতা-নেত্রী সভা শেষ করে চলে গেলে যা হয়, ভিড় পাতলা হয়ে আসে। এখানেও তাই হচ্ছে। কয়েক জন চিনারের ছায়ায় বসে তখনও গুলতানি করছেন দেখে এগিয়ে গেলাম। সেখানে শুধুই যন্ত্রণার স্বর। শাহজাদ আহমেদ সেতারির স্থানীয় একটি সাইকেল সারানোর দোকান টিমটিম করে চলে। এক ছেলেকে কিছুটা পড়িয়েছিলেন কিন্তু ভয়ের চোটে তাঁকে সৌদি আরবে মজদুরি করতে পাঠাতে হয়েছে। কারণ, অন্য ছেলেকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে সন্ত্রাসবাদের অভিযোগে ‘পোটা’-য় আটক করে রেখে দেওয়া হয়েছে তিন বছর হতে চলল। কিছুই প্রমাণ হয়নি, বাবা-মাও সন্তানকে আর
দেখতে পাননি।
ইলতিজ়া মুফতি টগবগে কণ্ঠস্বরে ব্যক্তিগতভাবে এই পরিবারকে বিচারের প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পর তাঁরা অন্তত কিছু দিনের জন্য আশায় বুক বাঁধতে চাইছেন।