গোয়ালপাড়ার নির্মীয়মাণ ডিটেনশন ক্যাম্প। নিজস্ব চিত্র। ইনসেটে নরেন্দ্র মোদী।
‘‘প্রধানমন্ত্রীর কথা যদি সত্যি হয়, তা হলে রাত ২টোর সময়ে পুলিশ ঘুম থেকে টেনে তুলে কোথায় নিয়ে গিয়েছিল?’’ জিজ্ঞাসা গোয়ালপাড়ার শ্যামল ঘোষের।
‘‘ডিটেনশন ক্যাম্প নেই! তা হলে আমার ছেলে সুব্রত দে মরল কোথায়?’’ অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন গোয়ালপাড়ার আশুডুবির বাসিন্দা অণিমা দে।
কৃষ্ণাইয়ের রবি দে ভেবে পাচ্ছেন না, ডিটেনশন ক্যাম্প যদি মিথ্যেই হয়, এত দিন তবে কোথায় ছিলেন তিনি? কোথা থেকে মুক্তি পেলেন? আর নিয়ম করে থানাতেই বা হাজিরা দিয়ে যেতে হচ্ছে কেন?
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী গত কাল দিল্লিতে বলেছেন, ডিটেনশন সেন্টার ব্যাপারটা কংগ্রেসি ও নকশালদের অপপ্রচার। দেশে নাকি ডিটেনশন ক্যাম্প বা এমন কোনও সেন্টারই নেই!
প্রধানমন্ত্রীর মুখে এমন কথা শুনে হতবাক বাপন দেব। তাঁর মা কাজলবালা দেব গত বৃহস্পতিবারেই শিলচর ডিটেনশন ক্যাম্প থেকে মুক্তি পেয়েছেন। ২০১৭ সালের ২০ এপ্রিল ফরেনার্স ট্রাইবুনাল তাকে বিদেশি ঘোষণা করে ক্যাম্পে পুরে দিয়েছিল। হাইকোর্টে আপিল, ফের ট্রাইবুনালে দৌড়ঝাঁপ। শেষে কাজলবালা মুক্তি পেলেন বটে, কিন্তু তত দিনে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছেন। দিনমজুর ছেলে বাপন তপ্ত প্রশ্ন ছোড়েন, ‘‘মা তা হলে কোথায় গিয়ে পাগল হলেন? কোথা থেকে তাঁকে বার করে আনার জন্য এত ছোটাছুটি করলাম?’’
চন্দ্রধর দাস জামিনে মুক্তি পেলেও এখনও মামলা চলছে ফরেনার্স ট্রাইবুনালে। ১০২ বছরের চন্দ্রধর বিছানায় শুয়ে শুধু প্রার্থনা করেন, মৃত্যুর আগে যেন শুনে যেতে পারেন, তিনি ভারতীয়ই।
অথচ এই মোদীই ২০১৪ সালে শিলচরে এসে ভোটের প্রচারে বলেছিলেন, ক্ষমতায় এলে ডিটেনশন ক্যাম্প গুঁড়িয়ে দেবেন৷ সেই কথা মনে করিয়ে চন্দ্রধরবাবুর আইনজীবী সৌমেন চৌধুরীর প্রশ্ন, ‘‘ডিটেনশন ক্যাম্প যদি না-ই থাকে, তবে তিনি কী গুঁড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন?’’
আরও পড়ুন: সত্য ফাঁস! এনআরসি হবে, মোদী তো বলেছিলেন এপ্রিলেই
অসমে প্রত্যেক বিধানসভা অধিবেশনেই রাজ্য সরকার ছ’টি ডিটেনশন ক্যাম্পে বন্দি থাকা লোকেদের তথ্য জমা দেয়। প্রশ্ন উঠেছে, সেগুলি কি তবে মিথ্যা? সম্প্রতি শেষ হওয়া বিধানসভা অধিবেশনেও রাজ্য সরকারের তরফে মন্ত্রী চন্দ্রমোহন পাটোয়ারি হিসেব দিয়েছেন। জানিয়েছেন, বর্তমানে রাজ্যের তেজপুর, কোকরাঝাড়, গোয়ালপাড়া, শিলচর, যোরহাট ও ডিব্রুগড়ে ছ’টি ডিটেনশন ক্যাম্পে মোট ৯৮৮ জন রয়েছেন। এখনও পর্যন্ত ২৮ জনের মৃত্যু হয়েছে ডিটেনশন ক্যাম্পগুলিতে। তিন বছরের বেশি আটক থাকা ৮৬ জনকে শর্তাধীন জামিনে মুক্তি দেওয়ার অনুমতি দিয়েছে রাজ্য সরকার। তাঁদের মধ্যে ৭৩ জন ইতিমধ্যে মুক্তি পেয়েছেন।
বর্তমান ছ’টি ডিটেনশন ক্যাম্প আদতে জেলা কারাগারেরই একটি অংশ নিয়ে তৈরি করা হয়েছে। রাজ্য স্বরাষ্ট্র দফতর জানাচ্ছে, কেন্দ্র থেকে পাওয়া সাড়ে ৪৬ কোটি টাকায় গোয়ালপাড়ার দলগোমায় অসম পুলিশ হাউসিং বোর্ড নতুন ডিটেনশন সেন্টার গড়ছে।
আরও পড়ুন: রাজ্যে ফের এনআরসি চেয়ে কোর্টে যাবে অসম
সেটা শুধুই ঘোষিত বিদেশিদের জন্য। সেখানে মোট ১৫টি ব্লকে ৩০০০ ‘বিদেশি’কে রাখা যাবে। এমন আরও ১০টি ডিটেনশন ক্যাম্প তৈরি হওয়ার কথা। মোদী বলছেন ডিটেনশন ক্যাম্পের ব্যাপারটা নাকি কংগ্রেসের ভাঁওতা। আর দলগোমায় ক্যাম্প তৈরির খরচ জোগাচ্ছে তাঁরই সরকার! মিথ্যা কত দূর যেতে পারে ভেবে পাচ্ছেন না অনিমা দে, রবি দে, শ্যামল ঘোষ, চন্দ্রধর দাসরা। আর বাপন দেবের মা কাজলবালা তো এই সব সত্যমিথ্যে বোঝার ক্ষমতাই নেই!
রাজ্য সরকারের মুখপাত্র তথা নেডা চেয়ারম্যান হিমন্তবিশ্ব শর্মা অবশ্য এর পরেও প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যকে সমর্থন করেছেন। তাঁর কথায়, ‘‘প্রধানমন্ত্রী বলতে চেয়েছেন কেন্দ্র কোনও ডিটেনশন সেন্টার বানায়নি। অসমের প্রেক্ষিত ভিন্ন। কারণ সেখানে ডি-ভোটার সংক্রান্ত মামলার জেরে গৌহাটি হাইকোর্টের নির্দেশে ডিটেনশন সেন্টার তৈরি করা হয়। কেন্দ্রের নির্দেশে নয়। হাইকোর্টের নির্দেশ কার্যকর করতে কেন্দ্র টাকা দিয়েছিল মাত্র।’’ কিন্তু মহারাষ্ট্র সরকার যে বলেছে, কেন্দ্রের নির্দেশ পেয়েই তারা ডিটেনশন সেন্টার তৈরির জন্য জমি বাছাই করছে! গত মাসেই কর্নাটকে অনুপ্রবেশ সংক্রান্ত মামলায় কেন্দ্র আদালতকে জানিয়েছিল প্রথমে ২০১৪ সালে সব রাজ্যে ডিটেনশন সেন্টার গড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। ২০১৮ সালে ফের সেই কথা মনে করিয়ে চিঠি দেওয়া হয়।
এ বার পিছু হটে হিমন্তবিশ্ব বলেন, ‘‘আমি অসমের সামান্য অর্থমন্ত্রী। গোটা দেশের ব্যাপার নিয়ে মত দিতে অক্ষম।’’
প্রদেশ কংগ্রেসের বক্তব্য, ‘‘মোদী আসলে সব কিছুই ছেলেখেলায় পরিণত করেছেন। এক বার বলছেন এনআরসি হবে, এক বার বলছেন, তেমন কথাই হয়নি। এক বার তিনি বলছেন, ডিটেনশন সেন্টার ভেঙে দেবেন। তিনিই আবার নতুন ডিটেনশন সেন্টার গড়তে টাকা পাঠাচ্ছেন। এখন আবার বলছেন, ডিটেনশন সেন্টার বলে কিছুই নেই। এমন প্রধানমন্ত্রীর শুধু মিথ্যাচারীই নন, দেশের পক্ষে বিপজ্জনক।’’