ভারত বায়োটেক গোটা পরীক্ষাটি শেষ করতে ১৫ মাস সময় চাইলেও আইসিএমআর-এর লক্ষ্য, আগামী ১৫ অগস্ট। প্রতীকী ছবি।
অন্তত ৬৪ সপ্তাহ। করোনার প্রতিষেধক কোভ্যাক্সিন টিকা বাজারে আনতে অন্তত এক বছর তিন মাস সময় লাগবে বলে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালস রেজিস্ট্রি–ইন্ডিয়া (সিটিআরআই)-কে আগেই জানিয়ে দিয়েছিল ভারত বায়োটেক। কিন্তু সরকারের নির্দেশ, আগামী ৭ জুলাই থেকে পরবর্তী পাঁচ সপ্তাহ অর্থাৎ ১৫ অগস্টের মধ্যে সব পরীক্ষা শেষ করে বাজারে আনতে হবে কোভ্যাক্সিন টিকা। কী করে এর মধ্যে প্রয়োগ, পর্যবেক্ষণ ও ভাল-মন্দ বিচার করে টিকা বাজারে আসবে, তা নিয়ে সংশয়ে বিশেষজ্ঞরা। আমজনতার জীবনের প্রশ্নে অযথা তাড়াহুড়ো নিয়ে সরব বিরোধীরাও। সমালোচনার মুখে বায়োটেকের সঙ্গে হাত মিলিয়ে টিকা তৈরির কাজে নামা স্বাস্থ্য মন্ত্রকের অধীনস্থ ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব মেডিক্যাল রিসার্চ (আইসিএমআর) আজ জানিয়েছে, লাল ফিতের জট এড়াতেই ওই পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। দ্রুত কাজ করতে গিয়ে কোনও ভাবেই মানুষের প্রাণের সঙ্গে ঝুঁকি নেওয়া হবে না।
ইতিমধ্যেই দেশের ১২টি হাসপাতালকে ওই টিকার গুণাগুণ পরীক্ষার জন্য বেছে নিয়েছে কেন্দ্র। গত কাল আইসিএমআর ওই কেন্দ্রগুলিকে টিকা পরীক্ষা সংক্রান্ত যে নির্দেশ দিয়েছে, তার সঙ্গে একাধিক ফারাক রয়েছে বায়োটেক সংস্থার সিটিআরআই-কে জমা দেওয়া পরিকল্পনার। বায়োটেক ১৩ জুলাই থেকে পরীক্ষামূলক প্রয়োগ শুরু করতে চাইলেও আইসিএমআর-এর ফরমান, ৭ জুলাইয়ের মধ্যে স্বেচ্ছাসেবক নথিভুক্ত করে টিকা প্রয়োগের কাজ শুরু করে দিতে হবে। আইসিএমআর-এর চিঠিতে কিছুটা হুমকির সুরেই বলা হয়েছে, সরকারের শীর্ষ স্তর থেকে গোটা বিষয়টি নজর রাখা হচ্ছে। নির্দেশ না মানা ভাল চোখে দেখা হবে না।
প্রতিষেধক পরীক্ষা কী ভাবে
• পরীক্ষা করা হবে ১১২৫ জন স্বেচ্ছাসেবকের উপরে
• প্রথম ধাপে ৩৭৫ জন
• দ্বিতীয় ধাপে ৭৫০ জন
• বিজ্ঞাপন দিয়ে নয়। স্বেচ্ছায় যাঁরা এগিয়ে আসবেন, তাঁদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার পর প্রতিষেধক প্রয়োগ। শর্ত, তাঁরা কোভিড আক্রান্ত নন এবং অন্য কোনও রোগ নেই
• ভ্যাকসিন: বিবিভি১৫২
• ডোজ়: ০.৫ মিলিলিটার
• কোথায়: ইন্টারমাস্কুলার ইঞ্জেকশন
• ডোজ়: দু’টি। ফারাক ১৪ দিনের
• প্ল্যাসিবো প্রভাব দেখার জন্যে—জেনভ্যাক (জাপানিজ় এনসেফ্যালাইটিস ভ্যাকসিন)। এটিও ইন্টার মাস্কুলার ও ১৪ দিনের ব্যবধানে দু’টি ডোজ়
• বয়স: ১২ থেকে ৬৫। শিশুদের ক্ষেত্রে বাবা-মায়ের অনুমতি
• সময়: ১ বছর ৩ মাস লাগবে বলে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালস্ রেজিস্ট্রি-ইন্ডিয়া-কে জানিয়েছে ভারত বায়োটেক
• কিন্তু সরকারের লক্ষ্য ১৫ অগস্টের মধ্যে টিকা বাজারে ছাড়া
• প্রথম পর্ব: ২৮ দিন। শরীরে কোনও ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে কি না দেখে ফেজ় টু-তে সম্মতি
• দ্বিতীয় পর্বে নজর রাখা হয় শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরির বিষয়টি। একই সঙ্গে প্রায় ১৯৪ দিন নজরে রাখতে বলা হয়েছে স্বেচ্ছাসেবকদের
ভারত বায়োটেক গোটা পরীক্ষাটি শেষ করতে ১৫ মাস সময় চাইলেও আইসিএমআর-এর লক্ষ্য, আগামী ১৫ অগস্ট। টিকার সঙ্গে আমজনতার প্রাণ জড়িত থাকায় ঝুঁকি নিতে নারাজ ওড়িশার ইনস্টিটিউট অব মেডিক্যাল সায়েন্স অ্যান্ড এসইউএম হাসপাতালে গবেষণার দায়িত্বে থাকা অধ্যাপক চিকিৎসক ই বেঙ্কট রাও। তিনি বলেন, আইসিএমআরের নির্দেশ মেনে চলা হবে। কিন্তু সুরক্ষার প্রশ্নে আপস করা হবে না। কবে প্রতিষেধক বাজারে আসার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল সেটি কতটা নিরাপদ। বিরোধীদের মতে, ১৫ অগস্ট স্বাধীনতার দিনে ভারত কোভিড ভ্যাকসিন হাতে পেল— এমন প্রচার করে বাজার মাত করতে চাইছেন নরেন্দ্র মোদী। এক বিরোধী নেতার কথায়, সব কিছু যে স্টান্ট নয়, সেটা প্রধানমন্ত্রীকে বুঝতে হবে। নোটবাতিল, জিএসটি, সার্জিক্যাল স্ট্রাইক বা হালে লকডাউন করে চমক দিতে গিয়ে দেশবাসীর সর্বনাশ করেছেন মোদী। আর এটা বিজ্ঞান। গবেষণা নির্ভর। এখানে চমক চলে না। সিপিএম নেতা সীতারাম ইয়েচুরিও বলেন, বরাত দিয়ে দিনক্ষণ ঘোষণা করে টিকা আবিষ্কার করা যায় না। কংগ্রেস নেতা জয়রাম রমেশ জানিয়েছেন, আগামী ১০ জুলাই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রকের স্থায়ী কমিটির বৈঠকে বিষয়টির ব্যাখ্যা চাওয়া হবে।
আরও পড়ুন: সেরে ওঠার ২৮ দিনের আগে প্লাজ়মা দেওয়া নয়
আরও পড়ুন: এক দিনে আক্রান্ত ২৩ হাজার ছুঁইছুঁই
প্রাথমিক ভাবে ভারত বায়োটেক ১১২৫ জন সুস্থ স্বেচ্ছাসেবকের উপর ওই পরীক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রথম পর্বের পরীক্ষা হবে ৩৭৫ জনের উপরে। ১২টির
একটি কেন্দ্র কানপুরের প্রখর হাসপাতালের গবেষক জিতেন্দ্র সিংহ কুশওয়ার তরফে সহকারী গবেষক অনুপমা বর্মা জানান, স্বেচ্ছাসেবকদের শূন্য ও ১৪ দিনের মাথায় কোভ্যাক্সিন (বিবিভি১৫২) টিকা দিয়ে পর্যবেক্ষণে রাখা হবে। প্রথম দু’ঘণ্টায় ও তার পরের সাত দিন ধরে দেখা হবে তাঁদের দেহে কোনও ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে কিনা। ২৮ দিনে শরীরে টিকার প্রভাব সংক্রান্ত তথ্য জানিয়ে ড্রাগ কন্ট্রোল অথরিটি-কে রিপোর্ট দেবে ১২টি সংস্থা। সব ইতিবাচক থাকলে ফেজ-২ অর্থাৎ দ্বিতীয়
পর্বের টিকা প্রয়োগ শুরু হবে। প্রশ্ন এখানেও। বায়োটেকের কর্ণধার চিকিৎসক কৃষ্ণ এলা-র দাবি, এই টিকা প্রাণীদেহে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলেনি। তাঁর আশা, এটা মানবদেহেও ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে না। কিন্তু ঘটনা হল, মানবদেহে প্রথম দফার ফল নেতিবাচক হলে নতুন করে গবেষণা শুরু হবে। সে ক্ষেত্রে সময়সীমা কী ভাবে রক্ষা করা সম্ভব হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।
প্রথম ধাপ উতরে গেলে দ্বিতীয় ধাপে ৭৫০ জন স্বেচ্ছাসেবককে দু’দলে ভাগ করে ফের শূন্য ও ১৪ দিনের মাথায় টিকা দেওয়া হবে। এক দল পাবে কোভ্যাক্সিন ও প্ল্যাসিবো। প্রভাব দেখার জন্য দ্বিতীয় দলকে জাপানিজ এনসেফ্যালাইটিস ভ্যাকসিন দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। এমসের টিকা সংক্রান্ত গবেষণার দায়িত্বে থাকা চিকিৎসক সঞ্জয় রাই জানিয়েছেন, প্ল্যাসিবো ট্রায়াল প্রতিটি টিকা বা ওষুধের পরীক্ষায় প্রয়োগ হয়ে থাকে। এই দ্বিতীয় ধাপে দেখা হবে, টিকা প্রয়োগে শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে কি না। যদি হয়, তা হলে বুঝতে হবে টিকার প্রয়োগ সফল। বিশেষজ্ঞদের একাংশের আশঙ্কা, এ ক্ষেত্রে যে হেতু সময় কম, তাই প্রথম ধাপে যাঁদের টিকাকরণ হবে, মূলত তাঁদের শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হচ্ছে কি না, তা দেখেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। যদিও আইসিএমআর আজ জানিয়েছে, তারা আন্তর্জাতিক টিকা সংক্রান্ত যে বিধিনিষেধ রয়েছে, তা অনুসরণ করেই এগোচ্ছে।
পরীক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় স্বেচ্ছাসেবক বেছে নেওয়ার প্রশ্নে বলা হয়েছে, সুস্থ হওয়া করোনা রোগী বা করোনা রোগীর সঙ্গে এক বাড়িতে থাকা ব্যক্তি যোগ দিতে পারবেন না। শরীরে রক্তের উপদানে ভারসাম্যের অভাব, কোনও জটিল অসুখ, অতীতে ক্যান্সার হওয়ার ইতিহাস, ড্রাগ বা মদ্যপানের জন্য অসুস্থতা, এক মাসের মধ্যে অন্য কোনও টিকা নিলে এ কাজে যোগ দেওয়া যাবে না। অন্তঃসত্ত্বা মহিলাদের ক্ষেত্রেও বারণ রয়েছে। অতিরিক্ত ওজন থাকলেও জায়গা হবে না স্বেচ্ছাসেবক দলে।