ভেঙে যাওয়া নদীবাঁধ। ছবি: লেখক
আমরা চামোলি এলাকার বাসিন্দা। নদীর পাড়ে আমাদের এলাকা। মোটামুটি শান্ত। বহু দিনই এখানে ধস বা অন্য ধরনের বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগ আমরা দেখিনি। তাই বোধ হয় খানিক অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল শান্তিতে থাকাটা। রবিবার সকাল সাড়ে ১০টা নাগাদ হঠাৎ সেই শান্তিটাই ছেদ পড়ল। খবর এল, উপরে জোশীমঠের কাছে মেঘ বা হিমবাহ ফেটেছে, জল বাড়ছে। যে কোনও সময়ে সেই জল পৌঁছে যেতে পারে আমাদের এলাকাতেও।
খবরটা মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ল গোটা অঞ্চলে। নদীর ধারে যাঁদের বাড়ি, তাঁরা বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছেন। হাঁ করে তাকিয়ে আছেন নদীপথ ধরে উত্তর দিকে। প্রতিটা মুহূর্ত ভয়ের। কী করব বুঝে উঠতে পারছি না। এই বোধহয় জল এসে পড়ল।
চামোলিতে আমাদের এলাকাটা সরাসরি অলকানন্দ নদীর পাড়ে নয়। কিন্তু তার শাখানদী নন্দাকিনীর ধারেই। অলকানন্দায় জল বাড়লে, ভেসে যেতে পারে নন্দাকিনীর দু’পাড়ও। তাই আতঙ্ক ছড়াতে সময় লাগেনি। প্রশাসনের তরফেও হঠাৎ বলা হয়, নদীর ধারের বাড়িগুলো খালি করে দিতে। আমরাও দ্রুত বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়ি। শীতের সকালে সকলে রাস্তায় দাঁড়িয়ে। এই বুঝি জল এসে পড়ে। কিন্তু না, তেমন মারাত্মক ঘটনা চামোলিতে ঘটেনি।
ঘণ্টা খানেকের মধ্যে খবর আসে, পরিস্থিতি এখন অনেকটা নিয়ন্ত্রণে। জলতল পুরোপুরি স্বাভাবিক উচ্চতায় ফিরে না এলেও বিপদসীমার থেকে নেমে গিয়েছে। এত ক্ষণ শুধু নিজের কথা, নিজের পরিবারের কথাই ভাবতে ব্যস্ত ছিলাম। জল বাড়ছে ভেবে, দামি জিনিসপত্র বাড়ি থেকে বের করে এনে হাতে নিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। সেই চিন্তাটা আস্তে আস্তে কমে আসে। ওটা সরে যেতেই আর একটা ভাবনা মনে এল। তপোবন জলবিদ্যুৎ প্রকল্পে বহু পরিচিতই কাজ করেন। ওঁদের কিছু হয়নি তো! তত ক্ষণে খবর আসতে শুরু করেছে, ওই এলাকা ভেসে গিয়েছে। আমাদের গ্রামের অনেকেই তো ওখানে যেতেন। তাঁদের কী হল? প্রত্যেকে ফোনের বোতাম টিপছেন। নেটওয়ার্কের হাল খারাপ। আর অপেক্ষা করা যাচ্ছে না। দুপুর ১২টা নাগাদ গাড়ি নিয়ে ছুটি তপোবনের দিকে।
কয়েক ঘণ্টা আগে এখানে ছিল বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র। এখন শুধুই ধ্বংসাবশেষ ছবি: লেখক
জোশীমঠ থেকে একটা রাস্তা গিয়েছে বদ্রীনাথের দিকে, অন্য রাস্তা কামেট পর্বত-মুখী। বদ্রীর সীমান্তের দিকে যাওয়ার জন্য যেমন মানা পাস, কামেটের দিকে চিনের সীমান্তে পৌঁছনের রাস্তা নিতি পাস। সীমান্তে যাওয়ার রাস্তা এই একটাই। আর সেই রাস্তার কাছে হিমবাহ-ফাটা জল নেমে এসেছে বলেই শুনেছি। ফলে প্রথমেই মনে হল, ও দিকে সেনাবাহিনীর যাওয়া-আসার পথটা হয়তো ভেঙে গিয়েছে। তাই ওই দিকেই গাড়ি চালিয়ে দিলাম।
তপোবন পৌঁছলাম ওই রাস্তা দিয়েই। রাস্তার হাল বেহাল নয়। কিন্তু তপোবন পৌঁছে যে দৃশ্য দেখলাম, তা দেখে শিউরে উঠতে হয়। নীচে এ দিক, ও দিকে পড়ে আছে বেশ কয়েক জনের মৃতদেহ। স্থানীয় মানুষ বলছেন, পাশের টানেলে আটকে আছেন শতাধিক মানুষ। হাজির হয়েছেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা। তখন দুপুর আড়াইটে। শোনা যাচ্ছে, উপর থেকে টানেল খুঁড়ে উদ্ধারকাজ চালানো হবে। কে জানে, কী অবস্থা ওখানে!
কারা আটকে আছেন টানেলের মধ্যে? আদৌ কি তাঁরা আর বেঁচে আছেন? ওই দলে পরিচিত কেউ নেই তো? আতঙ্কের মধ্যে কাটল কয়েক ঘণ্টা। কী করব, বুঝতে পারছি না। আমার ক্ষমতা সীমিত। আমি তো পারব না, নিজে কাউকে উদ্ধার করতে। হাতের মোবাইলটা সারাক্ষণ বেজে চলেছে। ‘এর কোনও খবর পেলে’, ‘ওর কথা জানো’— একটা ফোন রাখতে না রাখতে আরেকটা ঢুকছে। হঠাৎই এক বন্ধুর বাড়ি থেকে ফোন। খবর পেলাম জোশীমঠে সেই বন্ধুর খোঁজ নেই। বেঁচে আছে তো? জানি না। কেউ জানে না। গাড়ি নিয়ে ছুটলাম সে দিকে।
বন্যার পর ভাঙাচোড়া তপোবন এলাকা ছবি: লেখক
দুপুরের শেষ দিকে যখন পৌঁছলাম জোশীমঠ, তখন সেখানে পৌঁছে গিয়েছেন উত্তরাখণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী ত্রিবেন্দ্র সিংহ রাওয়াত। স্থানীয় ঋষিগঙ্গা বিদ্যুৎ প্রকল্প সম্পূর্ণ ভেসে গিয়েছে। রেনি সেতুও পুরো ধ্বংস। মুখ্যমন্ত্রীর দলের সঙ্গেই হাত লাগিয়ে এই এলাকায় আমি এবং আমার বন্ধুরা শুরু করলাম উদ্ধারকাজ। এরই মধ্যে পৌঁছে গিয়েছেন বায়ুসেনার জওয়ানেরাও। কিন্তু আমার সেই বন্ধুর এখনও খোঁজ নেই। কাজের প্রয়োজনে জোশীমঠ আসলেও, সেই বন্ধুর বাড়ি বলাগাঁওয়ে।
জোশীমঠ থকে কিছুটা উত্তরে বলাগাঁওয়ের দিকে সংযোগ পুরো বিচ্ছিন্ন। কারণ যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম রেনি সেতু আর নেই। ফলে উত্তরের ৮-৯টা গ্রাম পুরো সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে। বলাগাঁও, রেনি, প্যাং, লতা-র মতো গ্রামের সঙ্গে কোনও যোগাযোগই নেই। কেমন আছে ওরা? ফোন করলাম। নেটওয়ার্ক নেই। ‘এনগেজ’ থাকার শব্দ আসছে। আরও কেউ ফোন করছে কি? জানি না। ফোনে পেলাম না।
এখন অপেক্ষা ছাড়া আর কোনও উপায় নেই। চারপাশে প্রকৃতির ধ্বংসলীলার চিহ্ন। মানুষের বানানো যন্ত্র, ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাটের ছিটেফোঁটাও নেই কিছু কিছু জায়গায়। বহু মানুষও আর নেই। পরিচিত অনেকেই হয়তো প্রকৃতির গ্রাসে হারিয়ে গিয়েছেন চিরতরে। সেই তালিকা পেতে আরও সময় লাগবে। কিন্তু জানি, অনেককেই আর ফিরে পাব না। এই ধ্বংসের মধ্যে বসে একটাই প্রার্থনা, উপরের গ্রামগুলোয় যখন পৌঁছব, তখন যেন পরিচিত মুখগুলো আবার দেখতে পাই।