নটবরের বই-বোমা নিস্ক্রিয় করতে পাল্টা বই লেখার হুঁশিয়ারি দিলেন কংগ্রেস সভানেত্রী সনিয়া গাঁধী। আজ সনিয়া বলেন, “এ বার আমিও বই লিখব। তখনই সবাই আসল সত্যিটা জানতে পারবেন।”
গত কালই এক সাক্ষাৎকারে প্রাক্তন বিদেশমন্ত্রী নটবর সিংহ বলেছিলেন, “অন্তরাত্মার ডাকে সনিয়া প্রধানমন্ত্রী পদের দাবি ছেড়েছিলেন, তা একেবারেই ঠিক নয়। রাহুলই চাননি মা প্রধানমন্ত্রী হোন।” তার পরে ২৪ ঘণ্টা না কাটতেই এই প্রতিক্রিয়া সনিয়ার। নেত্রীর সমর্থনে আজ মুখ খোলেন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহও। তাঁর কথায়, “ঘরোয়া আলোচনায় এমন অনেক কথা হয়, যেগুলো বেচে মুনাফা করা ঠিক নয়।”
দুপুরে সংসদের সেন্ট্রাল হল থেকে বেরোচ্ছিলেন সনিয়া। তখনই নটবরের আত্মজীবনী ও সাক্ষাৎকার নিয়ে তাঁকে প্রশ্ন করা হলে দৃশ্যত রুষ্ট সনিয়া বলেন, “সত্যিটা একমাত্র তখনই প্রকাশ পাবে যদি আমি বই লিখি। এ ব্যাপারে আমি সিরিয়াস।” কংগ্রেস সভানেত্রী স্বীকার করেন, প্রিয়ঙ্কাকে নিয়ে তিনি নটবরের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। তিনি বলেন, “এর পরেও যদি উনি কিছু লেখেন তো লিখুন!”
সনিয়ার এই হুঁশিয়ারির পরেও অবশ্য থামতে নারাজ নটবর। বইয়ে এমনিতেই সনিয়া সম্পর্কে নানা বিশেষণ ব্যবহার করেছেন নটবর। কখনও ‘কর্তৃত্বপ্রিয়’ বলে সনিয়ার সমালোচনা করেছেন, তো কখনও বলেছেন ‘স্বৈরাচারী’। আজও তিনি বলেন, “সনিয়া একেবারেই দয়া-মায়াহীন।” নটবরের কথায়, তাঁর মতো ৪৫ বছর ধরে কংগ্রেস ও গাঁধী পরিবারের প্রতি অনুগত কারও সঙ্গে এতো নির্দয় আচরণ কেউ করতে পারেন না। নেহরু-ইন্দিরা বা রাজীবও কখনও তাঁর সঙ্গে এমন আচরণ করেননি। নটবরকে প্রশ্ন করা হয়, সনিয়া কি ইতালীয় বংশোদ্ভূত বলেই এত কঠোর! জবাবে নটবর বলেন, “হতে পারে। আমি প্রিয়ঙ্কাকেও এ ব্যাপারটা বলেছি।”
আজ আবার প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী রাজীব গাঁধীর বিদেশনীতির সমালোচনা করেন প্রাক্তন এই কূটনীতিক। নটবর বলেন, ওঁর কোনও কূটনৈতিক বুদ্ধিই ছিল না। রাজীবের বোকামির জন্য শ্রীলঙ্কার তামিল সমস্যায় হাত পুড়িয়েছিল সরকার। প্রভাকরণের কথা বিশ্বাস করে ভুল করেছিলেন রাজীব।
তবে নটবরের এই সব আক্রমণ আজ উড়িয়ে দেন কংগ্রেস সভানেত্রী। সনিয়া বলেন, “এ সবে আর আমি আঘাত পাই না। আমার শাশুড়িকে বুলেটে ঝাঁঝরা হতে দেখেছি। স্বামীর মৃত্যুও দেখেছি। তার পরে আর এ সব বাক্যবাণে বিদ্ধ হই না।”
নটবরের দাবি খারিজ করতে গত কাল থেকেই সরব কংগ্রেসের নেতারা। কিন্তু তার পরেও সনিয়া যে ভাবে আজ সরব হয়েছেন, তা তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন অনেকে। একে তো চলতি বিতর্কে সনিয়া কিছুটা দুর্বল অবস্থানে রয়েছেন। কারণ প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে, সনিয়া কেন নটবরের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন? তার মানে নটবর এমন কিছু খবর জানেন, যাতে বেকায়দায় পড়তে পারেন গাঁধী পরিবার।
তা ছাড়া নটবরের এই তথ্য ফাঁস রাহুলের রাজনৈতিক বোধ নিয়েও সওয়াল তুলে দিয়েছে। ঠাকুমা ও বাবার মৃত্যুর পরে সনিয়াকে নিয়ে রাহুলের উদ্বেগ স্বাভাবিক। কিন্তু দেশ আগে না মা? এই প্রশ্নও উঠছে এই কারণেই কি রাহুল প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হতে চাননি? তা যদি হয়, তা হলে দেশকে নেতৃত্ব দেওয়ার পক্ষে রাহুল কতটা যোগ্য? অনেকে মনে করছেন, রাহুলের ভবিষ্যৎকে মেঘমুক্ত করতেই সনিয়া আজ পাল্টা সরব হলেন।
সভানেত্রীকে আজ যোগ্য সঙ্গত দেওয়ার চেষ্টা করেন মনমোহনও। লোকসভা ভোটের আগে তাঁর প্রাক্তন মিডিয়া উপদেষ্টা সঞ্জয় বারু একটি বই লিখে দাবি করেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী মনমোহনের কোনও কর্তৃত্বই ছিল না। সব ক্ষমতা কুক্ষিগত ছিল সনিয়ার হাতে। তা ছাড়া প্রধানমন্ত্রী সচিবালয় থেকে নিয়মিত সরকারি ফাইল পাঠানো হতো দশ নম্বর জনপথে। নটবরও সেই একই অভিযোগ তাঁর বইয়ে করেছেন। আজ মনমোহন স্পষ্টই বলেন, প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয় থেকে কখনওই কোনও ফাইল সনিয়া গাঁধীর কাছে পাঠানো হয়নি।
সনিয়া-বিরোধী মন্তব্য করে কংগ্রেস বিরোধী শিবিরের কাছে রাতারাতি নায়ক বনে যাওয়া নটবর অবশ্য অনেকেরই আক্রমণের মুখে পড়েছেন। অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, ৯ বছর ধরে কেন চুপ ছিলেন নটবর? নটবরের ছেলে রাজস্থানে বিজেপির বিধায়ক। কংগ্রেসের একাধিক নেতারই অভিযোগ, নটবর এখন বিজেপির হাতে তামাক খাচ্ছেন।
তবে মুখে যাই বলুন, ঘরোয়া আলোচনায় কংগ্রেস নেতারাও স্বীকার করছেন, নটবর মুখ খোলায় দুর্দিনে আরও ক্ষতি হল কংগ্রেসের। দলের এক নেতার কথায়, লোকসভা ভোটে কংগ্রেসের বিপর্যয়ের পর ফের ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য সনিয়া গাঁধীর ওপরেই বেশির ভাগ নেতা কর্মী এখনও ভরসা করছেন। তবে স্বস্তি একটাই, এবং তা-ও সেই সনিয়াই। বিশেষ করে যে ক্ষিপ্রতা ও মেজাজে আজ নটবর-বোমা নিস্ক্রিয় করতে তৎপর হয়েছেন নেত্রী।