একত্র: সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের বিরোধিতায় পার্ক সার্কাসের জমায়েতে। মঙ্গলবার। ছবি: সুমন বল্লভ
সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন (সিএএ) ও জাতীয় নাগরিক পঞ্জি (এনআরসি) সম্পর্কে বিশদে জানেন না। শুধু টেলিভিশনে, খবরের কাগজে দেখেছেন, এখন এ নিয়ে সারা দেশ উত্তাল। তবে বিষয়টা ঠিক কী, সে সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা নেই তাঁদের। তাঁরা শুধু এটুকু জানেন, ভাগাভাগির প্রশ্ন রয়েছে এর মধ্যে। আর ভাগাভাগির ব্যাপারটাই এখন তাঁদের কাছে অর্থহীন। কারণ টানা সাত বছরের লড়াই তাঁদের বুঝিয়েছে, এক হতে না পারলে কোনও প্রতিবাদই সফল হয় না।
একটানা কথাগুলো বলছিলেন বদ্রীনাথ সিংহ। দিল্লি গণধর্ষণ-কাণ্ডে নির্যাতিতার বাবা। একটু থেমে বললেন, ‘‘এনআরসি, সিএএ, এ সব কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যাপার। তেমন বিশদে জানি না, তাই এখনই মন্তব্য করতে পারব না। কিন্তু গত সাত বছরেরও বেশি সময় ধরে সুবিচারের জন্য যে লড়াইটা আমরা লড়েছি, তাতে সব ধর্মের মানুষ, সে তিনি হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান বা শিখ, যে-ই হোন না কেন— আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন।’’
২০১২ সালে নির্ভয়া গণধর্ষণ-কাণ্ড ঘটেছিল। ধর্ষণে অভিযুক্ত চার জনকে সম্প্রতি ফাঁসির নির্দেশও দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। আগামী ১ ফেব্রুয়ারি সেই নির্দেশ কার্যকর হওয়ার কথা। দোষীদের তরফে একের পর এক মামলা দায়েরের জেরে সুবিচার ক্রমশ পিছিয়েছে বলে আক্ষেপ রয়েছে বদ্রীনাথের। তিনি এবং তাঁর স্ত্রী এখন দেশে মহিলাদের উপরে নির্যাতন বন্ধের আন্দোলনে অন্যতম পরিচিত মুখ। দিল্লির দ্বারকা, যেখানে বদ্রীনাথেরা থাকেন সেখান থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরের শাহিনবাগে আরও একটি লড়াই চলছে এই মুহূর্তে। যে লড়াইয়ে শামিল হয়েছে গোটা দেশ।
নির্ভয়া-কাণ্ডেও সুবিচারের জন্য এককাট্টা হয়েছিলেন দেশের মানুষ। বদ্রীনাথ বলেন, ‘‘আমাদের ধর্ম কী, সেই পরিচয় বিচার করে দেশবাসী পাশে দাঁড়াননি। তাঁরা দাঁড়িয়েছেন এক জন মানুষ হিসেবে, এক জন ভারতীয় হিসেবে। আমাদের দুঃখটা তাঁদেরও স্পর্শ করেছে, তাই তাঁরা সঙ্গে থেকেছেন। ধর্মের পরিচয় যে আদতে কতটা তুচ্ছ, আমরা নিজেদের অভিজ্ঞতা দিয়ে গত সাত বছরে তা প্রতিনিয়ত বুঝতে পেরেছি।’’
কিন্তু ২০১২ সালের ওই ঘটনার পরেও দেশে মহিলাদের ধর্ষণ বা অত্যাচার কমেনি। বরং বেড়েছে। এই প্রসঙ্গ তুলে মানবাধিকার সংগঠনগুলির বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন বদ্রীনাথ। ‘‘ধর্ষণ বা মহিলাদের উপরে অত্যাচারের একটা অন্যতম কারণ হল, দোষীদের জন্যও মানবাধিকার সংগঠনগুলি গলা ফাটায়। কিন্তু যত ক্ষণ না দোষীদের দ্রুত ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হবে, তত ক্ষণ অপরাধীদের মনে ভয় জন্মাবে না। ভয় না জন্মালে অপরাধ ঘটতেই থাকবে’’— বলছেন তিনি।
আর তাই নির্ভয়া-কাণ্ডে দোষীদের ফাঁসি হওয়ার পরে তাঁদের লড়াই শেষ হয়ে যাবে বলে মনে করেন না বদ্রীনাথ। বরং যে সমস্ত মহিলা ধর্ষণের শিকার হয়েছেন, কোনও অত্যাচারের সম্মুখীন হয়েছেন, তাঁদের জন্য লড়াই জারি রাখতে চান তাঁরা।
ব্যক্তিগত পরিসর ডিঙিয়ে বৃহত্তর লড়াইয়ে অংশগ্রহণ— ভারতীয় সংস্কৃতির ইতিহাস তেমনই চিহ্ন রেখেছে বারবার। যার ব্যতিক্রম নন বদ্রীনাথেরাও। তিনি বলছেন, ‘‘যে সমস্ত মহিলা এখনও সুবিচার পাননি, তাঁদের জন্য লড়তে হবে। কে, কোন ধর্মের সেটা বিচার করে নষ্ট করার মতো সময় আমাদের হাতে নেই। ধর্ম-জাতপাত ভুলে এই মুহূর্তে এক হওয়াটাই জরুরি।’’