অর্থব্যবস্থার গুরুতর সঙ্কটগুলি সম্পর্কে বাজেটে বিশেষ কিছু থাকেনি। অবশ্য থাকেনি বললে ভুল হবে, রয়েছে প্রচুর বড় বড় প্রতিশ্রুতি।
অনেকগুলি কারণে বাজেট ২০১৮ বিশেষ ভাবে আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছিল। এক দিকে, সামনে লোকসভা নির্বাচন। এই পরিস্থিতিতে মোদী ও জেটলি ভোটের কথা মাথায় রেখে মানুষের সামনে কী বার্তা দেন তা জানার আগ্রহ ছিল। অন্য দিকে, সেই নির্বাচনী বাধ্যবাধকতার মধ্যে আর্থিক পরিস্থিতির সমস্যা কতটা অর্থমন্ত্রীর সামনে বাধা হয়ে দাঁড়ায় তা নিয়েও ছিল জল্পনা। এই পরিস্থিতিতে জেটলি যে বাজেট পেশ করলেন, তাতে কী পাওয়া গেল?
আনন্দবাজার ওয়েবসাইটে আগের নিবন্ধে লিখেছিলাম যে দেশের আর্থিক বৃদ্ধির হার নিম্নমুখী। কিন্তু অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতা শুনে মনে হল তিনি তা মানতে রাজি নন। তাই যেখানে কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান দর ২০১৭-’১৮ আর্থিক বছরে বৃদ্ধির হার ৬.১% থাকবে বলে অনুমান করছে, সেখানে অর্থমন্ত্রী অর্ধবৎসরে কত বৃদ্ধির হার হবে, সেই সংখ্যা পেশ করলেন। অর্থাৎ, তিনি আর্থিক বৃদ্ধির নিম্নগামীতাকে স্বীকার করতেই রাজি নন। সত্যকে অস্বীকার করার ফলে, অর্থব্যবস্থার গুরুতর সঙ্কটগুলি সম্পর্কে বাজেটে বিশেষ কিছু থাকেনি। অবশ্য থাকেনি বললে ভুল হবে, রয়েছে প্রচুর বড় বড় প্রতিশ্রুতি কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতিকে বাস্তবায়িত করার জন্য যে আর্থিক সংস্থানের প্রয়োজন, তা অর্থমন্ত্রী রাখেননি।
যেমন ধরা যাক কৃষি ও গ্রামীণ অর্থনীতির কথা। বাজেটের আগে, মিডিয়াতে প্রবল শোরগোল ছিল যে বাজেটে গ্রামীণ অর্থব্যবস্থা সংক্রান্ত বড়সড় ঘোষণা থাকবে। জেটলি সাহেব খাতায়কলমে নিরাশ করেননি। ঘোষণা করেছেন যে ২০১৮-’১৯ অর্থবর্ষে গ্রামীণ ভারতে বিভিন্ন খাতে খরচ করা হবে ১৪.৩৪ লক্ষ কোটি টাকা। চোখ কচলাতে হয়, সন্দেহ নেই। কিন্তু একটু গভীরে গিয়ে অথবা, বাজেট বক্তৃতার শেষে যে পরিশিষ্ট দেওয়া রয়েছে, তার দিকে তাকালেই এই ঘোষণার সারবত্তাহীনতা প্রমাণিত হবে। ১৪.৩৪ লক্ষ কোটি টাকার মধ্যে ১১ লক্ষ কোটি টাকা ধরা হয়েছে কৃষি ঋণ হিসেবে। ঋণ সরকারি খরচ নয়। ঋণ ব্যাঙ্ক দেয় এবং তা ফেরত দিতে হয়। তাই ঋণের পরিসংখ্যান বাজেটে দেওয়া বিভ্রান্তিকর। তার থেকেও বড় কথা গত বছর বাজেটে অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন যে কৃষি ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ১০ লক্ষ কোটি টাকা ধার্য করা হচ্ছে, যা সেপ্টেম্বর ২০১৭’র হিসেবে ৫ লক্ষ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। তাই ধরা যেতে পারে যে ঋণের পরিমাণ ২০১৭-’১৮-তে ১০ লক্ষ কোটি টাকা ছোঁবে। আরও এক লক্ষ কোটি টাকা ঋণ দিয়ে কৃষি অর্থব্যবস্থার সমস্যার সমাধান হবে না। বরং, কৃষকদের একটা বড় অংশের সমস্যাই এই যে তাঁরা কৃষি ঋণ ফেরত দিতে গিয়ে দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছেন। এমতাবস্থায় সরকার কিন্তু ঋণ মকুবের কোনও ঘোষণার দিকে গেলেন না।
আরও পড়ুন: ভোটের দায়ে জয় কিসান মোদী-জেটলির
আবার ঘোষণা করা হয়েছে যে, ন্যূনতম সহায়ক মূল্য কৃষিতে খরচের থেকে ৫০% বেশি করা হবে। উত্তম প্রস্তাব। কিন্ত মনে রাখতে হবে যে ভারতে সরকারের কাছে ফসল বেচে মাত্র ৬% কৃষক পরিবার। দ্বিতীয়ত, ভারতে যত গম উৎপাদিত হয় (২০১৭’র হিসেবে) তার ২৩% এবং ধানের ক্ষেত্রে ৩৫% ফসল সরকার কৃষকদের থেকে কেনে। বাকিটা খোলা বাজারে বিক্রি হয়। ন্যূনতম সহায়ক মূল্য বাড়ালেই চলবে না, কৃষকদের থেকে ফসল কিনতেও হবে। তার জন্য বাজেটে খুব বেশি অর্থ ধার্য করা হয়নি।
১১ লক্ষ কোটি টাকা কৃষি ঋণের হিসেব বাদ দিয়ে আমরা যদি কৃষি, গ্রামীণ উন্নয়ন ও সেচের ক্ষেত্রে বাজেট বরাদ্দের দিকে তাকাই, তা হলে দেখা যাবে যে, জিডিপির অনুপাতে এই খরচ ২০১৭-’১৮ অর্থবর্ষে ছিল ১.৬%, যা ২০১৮-’১৯ সালেও অপরিবর্তিত থাকবে। তাই সংবাদমাধ্যমে যতই গ্রামমুখী বাজেট বলে হইচই হোক, আসলে এই বাজেটে গ্রামীণ ক্ষেত্রে আদৌ প্রকৃত ভাবে বরাদ্দ বাড়ানো হয়নি। এমনকী, মহাত্মা গাঁধী জাতীয় রোজগার গ্যারান্টি প্রকল্পে এক টাকাও বরাদ্দ বাড়ানো হয়নি। কেন্দ্রীয় সরকার প্রকাশিত আর্থিক সমীক্ষায় দেখানো হয়েছে যে কৃষিতে বিনিয়োগের হার (মোট উৎপাদনের অনুপাতে) কমেছে। কিন্তু জেটলি সাহেবের বাজেটের ফলে সেই বিনিয়োগ বাড়বে বলে মনে হয় না।
দ্বিতীয় যে বড় ঘোষণা এই বাজেটে করা হয়েছে, তা হল স্বাস্থ্য নিয়ে। বলা হয়েছে, ১০ কোটি গরিব পরিবারের জন্য ৫ লক্ষ টাকা অবধি স্বাস্থ্যবিমার ব্যবস্থা করবে সরকার। আবারও শুনতে খুব ভাল। কিন্তু দু’টি বিষয় রয়ে যাচ্ছে। প্রথমত, সরকারি টাকায় বিমার প্রিমিয়াম দিয়ে লাভ হয় বিমা কোম্পানিগুলির এবং বেসরকারি হাসপাতালের। সরকার যদি সত্যিই গরিব মানুষের কাছে উপযুক্ত স্বাস্থ্য পরিষেবা পৌঁছে দিতে আগ্রহী হত, তবে স্বাস্থ্য খাতে ব্যাপক বরাদ্দ বাড়িয়ে দেশজুড়ে হাসপাতাল ও উন্নত স্বাস্থ্য পরিকাঠামো নির্মাণের চেষ্টা করত। কিন্তু সরকারের তেমন কিছু করার ইচ্ছে নেই। প্রমাণ? ২০১৭-’১৮ সালে সরকার স্বাস্থ্য খাতে খরচ করে ৫৩১৯৮ কোটি টাকা যা ২০১৮-’১৯-এ বেড়ে হবে ৫৪৬৬৭ কোটি টাকা, অর্থাৎ বরাদ্দ বাড়ল মাত্র ১৪৬৯ কোটি টাকা, যা ভারতের মতো বিশাল দেশে নগণ্য। এই টাকা দিয়ে কত জন মানুষের বিমা করা যাবে তা-ও সহজেই অনুমেয়। তাই স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রেও সরকারের প্রতিশ্রুতি ও বাজেট বরাদ্দের মধ্যে বিস্তর ফারাক রয়ে গেছে।
সরকারের মোট রাজস্ব আয় ও ব্যয়ের হিসেবের দিকে তাকালে আমরা দেখব যে মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের অনুপাতে মোট ব্যয় ২০১৭-’১৮ সালের ১৩.৩% থেকে কমিয়ে ২০১৮-’১৯ সালে ১২.৯% করা হবে। যার মানে এই দাঁড়ায় যে সরকার ব্যয়সঙ্কোচের নীতি থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি, তা-ও এমন সময়ে যখন দেশের বৃদ্ধির হার নিম্নমুখী। আমরা আগের নিবন্ধেই বলেছিলাম যে আর্থিক ঘাটতির লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে, যা বাস্তবে হয়েছে। তাতে খুব বেশি সমস্যার কিছু নেই। কিন্তু সরকার আগামী বছরে এই ঘাটতি আরও কমাবে। তা করতে হলে, সরকারের রাজস্ব বাড়াতে হবে। সরকারের অনুমান অনুযায়ী, ২০১৮-’১৯ সালে জিএসটি বাবদ সরকারের আয় ৬ লক্ষ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে, যা এই বছরে ছিল ২.২ লক্ষ কোটি টাকা। এই বিপুল কর সংগ্রহ হওয়ার জন্য জিডিপি’র বৃদ্ধির হার সরকারের অনুমান অনুযায়ী বাড়তে হবে, যা এই বছরে হয়নি। অন্য দিকে, সরকার বিপুল ভাবে বিলগ্নীকরণের রাস্তায় হাঁটবে বলে বদ্ধপরিকর। বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী বলেছেন ২০১৭-’১৮ সালে প্রায় ১ লক্ষ কোটি টাকা বিলগ্নীকরণের মধ্য দিয়ে সংগ্রহ করা হয়েছে, যা আগামী বছরে হবে ৮০০০০ কোটি টাকা।
আরও পড়ুন: আয়করে অল্প ছাড়, বাড়তি বোঝা সেসের
প্রত্যক্ষ কর বাড়িয়ে রাজস্ব সংগ্রহ না করে সরকারি সম্পত্তি বেচে তা করার মধ্যে কোনও অর্থনৈতিক যুক্তি নেই। এক দিকে, ২৫০ কোটি টাকার কোম্পানিদের ক্ষেত্রে করের হার কমানো হচ্ছে, অন্য দিকে, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা সেস বাড়িয়ে সাধারণ মানুষের উপরে চাপ বাড়ানো হচ্ছে। বিগত কয়েক মাসে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বাড়ার ফলে, দেশেও তেলের দাম বাড়ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম যখন কম ছিল তখন সরকার শুল্ক লাগু করে মানুষকে তার সুবিধা পেতে দেয়নি। এখন দাম যখন বাড়ছে, তখনও সরকার শুল্ক কমাতে রাজি নয়। মধ্যবিত্ত চাকুরিজীবী মানুষের জন্যও বাজেটে খুব বেশি কোনও সুখবর নেই। আর একটি বিষয়ও বাজেটে নেই। তা হল বিমুদ্রাকরণের ফলে কত কালো টাকা ধরা পড়ল, কত বাড়তি কর পাওয়া গেল তার হিসেব। আর্থিক সমীক্ষা রিপোর্ট আমাদের জানাচ্ছে যে খুব বেশি বাড়তি কর নোট বাতিলের মধ্য দিয়ে সংগৃহীত হয়নি।
বাজেটের মূল সমস্যা হচ্ছে, বিভিন্ন গালভরা প্রতিশ্রুতি ও প্রস্তাবিত বরাদ্দের ফারাক। রাজনীতির আঙিনায় এই ফারাক কতটা বিজেপি’র সুবিধে বা অসুবিধে করবে তা রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলবেন।