এই বিশ্ববিখ্যাত ভারতীয় ব্র্যান্ডের সঙ্গে কিন্তু জড়িয়ে রয়েছে এক কুখ্যাত মানুষের পরিবারের নাম। অলঙ্করণ: শৌভিক দেবনাথ
এ দেশে আর কোনও মদের ব্র্যান্ড নিয়ে এত আবেগ আর আনুগত্য নেই বোধহয়। বিদেশেও এর রীতিমতো কদর। যিনি খান, যিনি এক সময় খেতেন কিন্তু এখন নানা কারণে ছাড়তে বা ব্র্যান্ড বদলাতে হয়েছে— সবার কাছেই ওল্ড মঙ্কের আদর প্রায় সমান। এই কনকনে শীতে অনেকেই ফিরে ফিরে যান এই বুড়ো সাধুর আশ্রয়ে। ওল্ড মঙ্ক যেন এক ঘরানা। এই বিশ্ববিখ্যাত ভারতীয় ব্র্যান্ডের সঙ্গে কিন্তু জড়িয়ে রয়েছে এক কুখ্যাত মানুষের পরিবারের নাম।
সালটা ১৮৫৫, মানে তখনও সিপাহি বিদ্রোহ হয়নি। শিমলা তখন ব্রিটিশদের গ্রীষ্মকালীন রাজধানী। এ দেশে বসবাসকারী ব্রিটিশদের মধ্যে সস্তার বিয়ার খাওয়ার চাহিদা লক্ষ করলেন স্কটিশ ব্যবসায়ী এডওয়ার্ড ডায়ার। তাই হিমাচলের কসৌলিতে বানিয়ে ফেললেন ব্রিউয়ারি। তৈরি হল ভারত তথা এশিয়ার প্রথম বিয়ার— লায়ন। ভারতেও সুরা পানের ইতিহাস বহু পুরনো। কিন্তু কয়েক হাজার বছরের ভারতীয় সভ্যতায় সুরার প্রথম ব্র্যান্ডিং করলেন কি না এক অভারতীয়।
বিয়ার ব্যবসা জমে উঠল। কিন্তু ডায়ার পরিবারের সামাজিক উত্তরণে এটাই হয়ে উঠল বাধার কারণ। সে সময় সিমলায় ছিল ব্রিটিশ সরকারের কেষ্টবিষ্টুদের বসবাস। কিন্তু মদ প্রস্তুতকারী বলেই ডায়ার পরিবারকে তেমন সম্মানের চোখে দেখা হত না। তাই বাড়ির ছোট ছেলেকে বিলেতে বোর্ডিং স্কুলে পাঠিয়ে দিলেন তার মা। আয়ারল্যান্ডে পড়াশোনা শেষ করে সে যোগ দিল সেনাবাহিনীতে। পরবর্তী সময়ে ভারতে ফিরে সেই রেগিনাল্ডই এমন কাণ্ড ঘটালেন, যা কালো দাগ হয়ে থাকল তাঁর অসাধারণ কেরিয়ারে। ১৯১৯ সালের ১৩ এপ্রিল, তত দিনে সেনাবাহিনীর কর্নেল হয়ে উঠেছেন রেগিনাল্ড। অমৃতসরের জালিয়ানওয়ালাবাগে তাঁর নির্দেশেই শান্তিপূর্ণ একটি জমায়েতে চলল গুলি। ঝাঁঝরা হয়ে গেল কমপক্ষে চারশো প্রাণ। ভারতের ইতিহাসের চিরকালের জন্য অন্যতম নিন্দিত চরিত্র হিসেবে চিহ্নিত হয়ে গেলেন কর্নেল ডায়ার।
অন্য দিকে তত দিনে শ্রীলঙ্কা, মায়ানমারেও খুলেছে সংস্থার শাখা। ডায়ার ব্রিউয়ারি মিশে গিয়েছে অপর এক ইংরেজ এইচ জি মিকিনের ব্রিউয়ারি সোলান মিকিন অ্যান্ড কোম্পানির সঙ্গে। কোম্পানির নাম বদলে হয়েছে ডায়ার মিকিন। গোটা উপমহাদেশে ব্যবসা বিস্তার তো হয়েইছে। সংস্থার মূল ব্রিউয়ারিও সরে এসেছে হিমাচলের সোলানে।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৪৯ সালে এই ব্রিটিশ ব্রিউয়ারি কিনে ফেললেন নরেন্দ্রনাথ মোহন। উত্তরপ্রদেশের গাজিয়াবাদে সরিয়ে আনলেন কোম্পানির কর্মকাণ্ড, তৈরি করলেন মোহন নগর। মূল কোম্পানির গোড়াপত্তনের প্রায় একশো বছর পর সেই ব্রিউয়ারির গর্ভগৃহ থেকে বেরোল একটা কালজয়ী ব্র্যান্ড। ১৯৫৪ সালের ডিসেম্বরে বাজারে এল ‘ওল্ড মঙ্ক’। মেক ইন ইন্ডিয়ার অন্যতম উৎকৃষ্ট উদাহরণ।
কিন্তু এই ডার্ক রামের নাম ওল্ড মঙ্ক কেন?
এন এন মোহনের বড় ছেলে কর্নেল বেদ রতন মোহনের হাতে তৈরি এই ব্র্যান্ড। প্রাক্তন এই সেনা অফিসার না কি ইউরোপের বেনেডিক্টিন সাধু ও তাদের তৈরি রামের দারুণ ভক্ত ছিলেন। সেই সূত্র ধরেই না কি ভারতের তৈরি এই রামের নাম ওল্ড মঙ্ক। আবার অন্য এক অংশের মতে, গাজিয়াবাদে গুমনামি বাবার সঙ্গে দেখা করে দারুণ প্রভাবিত হন ভিআর মোহন। বুড়ো সাধু গুমনামি বাবার ইংরেজি তর্জমাই হল ওল্ড মঙ্ক।
কিছু দিনের মধ্যেই সেনাবাহিনী আপন করে নিল এই স্বদেশি রামের ব্র্যান্ডকে। জনমানসেও ওল্ড মঙ্ক এতটাই জনপ্রিয় হল যে নয়ের দশকের গোড়ার দিকে ইউরোপে বিভিন্ন বারে বাকার্ডির চেয়ে এটা বেশি দামে বিক্রি হতো। ১৯৭৩-এ দাদার মৃত্যুর পর কোম্পানির হাল ধরলেন ভাই, ব্রিগেডিয়ার কপিল মোহন। মূলত তাঁর হাত ধরেই ওল্ড মঙ্কের ব্যবসা বহুগুণ বাড়ে। এবং গোটাটাই কোনও বিজ্ঞাপন ছাড়া। মজার কথা এই যে, কপিল মোহন নিজে একেবারেই মদ খেতেন না।
সদ্য মদ খেতে শেখা কলেজের ছেলেটা, কিংবা সব রকমের মদ চেখে নেওয়া পানীয় প্রিয় মানুষটা, ওল্ড মঙ্ক বাচ্চা বুড়ো সকলের কাছে জনপ্রিয়। এর একটা কারণ যদি হয় এর স্বাদ, অন্যটা এবং প্রধান কারণ অবশ্যই এর দাম। তাই কোনও বিজ্ঞাপন ছাড়াই দিব্যি বিকোয় ওল্ড মঙ্ক। সোলানের একটি ঝর্ণার জল এই রাম তৈরির অন্যতম উপাদান। ওল্ড মঙ্কের অনন্য স্বাদের উৎসও নাকি সেটাই। মোহন মিকিনে তৈরি হয় আরও নানা পানীয়— যেমন গোল্ডেন ইগল বিয়ার, সোলান নম্বর ওয়ান হুইস্কি। কিন্তু সে সবের কথা আর ক’জন মনে রাখে?
আইরনি এখানেই যে, যিনি ভারতের সবচেয়ে প্রিয় একটি ব্রান্ডের বীজ বপন করেছিলেন, সেই এডওয়ার্ড ডায়ার প্রায় বিস্মৃত। আর এ দেশের অন্যতম অপ্রিয় পাত্র হয়েও পাঁচশো মানুষের রক্তে হাত রাঙিয়ে ইতিহাস বইয়ে জায়গা করে নিয়েছেন তাঁর ছেলে রেগিনাল্ড। তাই ডায়ার বললে লোকের মনে পড়ে জালিয়ানওয়ালাবাগের সেই নৃশংস হত্যাকাণ্ড, অত্যাচারী এক সেনাকর্তার কথা।