—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
নয়াদিল্লি, ৭ ডিসেম্বর: সাত বছর আগে, ২০১৭ সালে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ২ লক্ষ ২১ হাজার মানুষ ভারতে চিকিৎসা করাতে এসেছিলেন। ২০২২-এ এসেছিলেন প্রায় ৩ লক্ষ ২৭ হাজার মানুষ। সে বছর প্রতিবেশী দেশ ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ থেকে যত মানুষ ভারতে চিকিৎসা করাতে এসেছেন, তার প্রায় ৬৭ শতাংশ মানুষই এসেছেন বাংলাদেশ থেকে। স্বাভাবিক নিয়মেই এই লক্ষ লক্ষ বাংলাদেশি মানুষের সিংহভাগই ভারতে এসে চিকিৎসার জন্য বাংলাদেশের সবথেকে কাছে থাকা কলকাতাকেই বেছে নিয়েছেন।
অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, বাংলাদেশে ক্ষমতার পালাবদল ও তারপর অশান্তির জেরে সে দেশ থেকে চিকিৎসার জন্য ভারতে আসা মানুষের সংখ্যা কমেছে। অর্থনীতির ভাষায় এই ‘চিকিৎসা পর্যটক’-দের সংখ্যা কমলে কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতিতে ধাক্কা লাগবে। কারণ, কলকাতার বিভিন্ন বড় হাসপাতাল থেকে হোটেল, রেস্তরাঁ ব্যবসা চিকিৎসার কারণে আসা বাংলাদেশিদের উপরে নির্ভরশীল। সীমান্তবর্তী হওয়ার কারণে বাংলাদেশিরা কলকাতার বিভিন্ন হাসপাতালেই চিকিৎসা করান। ভাষা, সংস্কৃতির মিল থাকার ফলেও তাঁরা মুম্বই বা দক্ষিণ ভারতের বদলে পশ্চিমবঙ্গকে প্রাধান্য দেন।
দিল্লির আর্থিক গবেষণা সংস্থা ‘ইন্টারন্যাশনাল কাউন্সিল ফর রিসার্চ অন ইন্টারন্যাশনাল ইকনমিক রিলেশনস’ বা আইসিআরআইইআর সম্প্রতি এ নিয়ে একটি গবেষণা রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। এ দেশের চিকিৎসা পর্যটনে বাংলাদেশের উপর নির্ভরতা নিয়ে সেই গবেষণা রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারতের চিকিৎসা পর্যটন শিল্পে সবথেকে বড় অংশীদার হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। চলতি বছরের অগস্টে শেখ হাসিনা গদিচ্যুত হওয়ার পরে ভারতের চিকিৎসা পর্যটন ক্ষেত্র ধাক্কা খেয়েছে। আন্দোলনের জেরে বাংলাদেশিদের যাতায়াত কমেছে। ভারতের ভিসা বিলি কেন্দ্রও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তার পরে ভিসা চালু করলেও পরিস্থিতি এখনও স্বাভাবিক হয়নি। ফলে বাংলাদেশ থেকে চিকিৎসা পর্যটক কমেছে। শুধু হাসপাতাল, তার সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন ক্ষেত্রে যার প্রভাব দেখা যাচ্ছে। সবথেকে বেশি
প্রভাব পড়েছে পশ্চিমবঙ্গ ও উত্তর-পূ্র্বাঞ্চলে। কারণ, এই সব অঞ্চলেই বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি চিকিৎসা পর্যটক আসেন।
পরিসংখ্যান বলছে, যে দশটি দেশ থেকে সবথেকে বেশি মানুষ ভারতে চিকিৎসা করাতে আসেন, তার মধ্যে বাংলাদেশ প্রথম। এ ছাড়া ওই তালিকায় রয়েছে ইরাক, ইয়েমেন, ওমান, মলদ্বীপ, সুদান, কেনিয়া, নাইজেরিয়া, তানজ়ানিয়া, মায়ানমার। উন্নত দেশগুলি থেকে আসা রোগীর সংখ্যা খুবই কম। ২০১৭-য় বিদেশ থেকে প্রায় ৪ লক্ষ ৯৪ হাজার মানুষ ভারতে চিকিৎসার জন্য এসেছিলেন। তার মধ্যে ৪৪.৮ শতাংশই বাংলাদেশি। ২০২২-এ এসেছিলেন প্রায় ৪ লক্ষ ৭৪ হাজার। তার ৬৮.৯ শতাংশ এসেছিলেন বাংলাদেশ থেকে। এর বাইরে বহু মানুষ সীমান্ত পেরিয়ে সীমান্তবর্তী স্বাস্থ্য কেন্দ্রে চিকিৎসা করিয়ে যান।
গবেষকদের বক্তব্য, চিকিৎসার মান নির্ধারণের জন্য ‘জয়েন্ট কমিশন ইন্টারন্যাশনাল’ (জেসিআই) ও ‘ন্যাশনাল অ্যাক্রিডিটেশন বোর্ড ফর হসপিটালস’ (এনএবিএইচ) নামের দুটি সংস্থা আছে। পূর্ব ভারতে এই জেসিআই অনুমোদিত তিনটি হাসপাতালই কলকাতায়। ৪৮টি এনএবিএইচ অনুমোদিত হাসপাতালের মধ্যে বেশির ভাগই পশ্চিমবঙ্গ ও অসমে। সেই কারণেও বাংলাদেশিরা কলকাতাতে বেছে নেন। বাংলাদেশের বিমা ভারতে না চলায় চিকিৎসার খরচ মূলত নগদ টাকায় মেটানো হয়।
বাংলাদেশের উপর নির্ভরতা কমাতে আইসিআরআইইআর বেশ কিছু সুপারিশ করেছে। তাতে অন্যান্য দেশ থেকেও চিকিৎসা পর্যটন টানতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু ওয়াকিবহাল মহলের মতে, তাতে সময় লাগবে। বণিকসভার এক কর্তা বলেন, ‘‘বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের উপরে হামলার প্রতিক্রিয়ায় অনেকে বাংলাদেশিদের চিকিৎসা দিতে অস্বীকার করছেন। কিন্তু এতে বাংলার অর্থনীতি ধাক্কা খাবে। হাসপাতালের ব্যবসা মার খাবে। তার ফলে কর্মী ছাঁটাই হতে পারে। নিউ মার্কেট থেকে ই এম বাইপাসে তৈরি বহু হোটেল বাংলাদেশি রোগীদের উপরে নির্ভরশীল। সেখানে কলকাতা ও রাজ্যের ছেলেমেয়েরা কাজ করেন। বাংলাদেশি রোগী না এলে এই হোটেলের ব্যবসা মার খাবে। অনেকেই রুটিরুজি হারাবেন।’’