Romila Thapar

কেন্দ্রীয় সরকারের ‘জাতীয়তাবাদ’-কে ইতিহাস আর গালগল্পের ফারাক বোঝালেন রোমিলা থাপার

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী থেকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বার বার ‘জাতীয়তাবাদ’-এর ধুয়ো তুলে নতুন করে ইতিহাস লেখার প্রয়োজনের কথা বলছেন।

Advertisement

প্রেমাংশু চৌধুরী

নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ১৬ জানুয়ারি ২০২৩ ০৬:২১
Share:

ইতিহাসবিদ রোমিলা থাপার। ছবি: সংগৃহীত।

মোগলদের অর্থনীতির ভার ছিল দেওয়ান রাজা টোডরমলের হাতে। হলদিঘাটে মোগলদের সঙ্গে রাজপুতদের যুদ্ধে আকবরের সেনার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন রাজা মান সিংহ। উল্টো দিকে মহারাণা প্রতাপের সেনাবাহিনীতে আফগান যোদ্ধাদের নেতৃত্বে ছিলেন শের শাহ সুরির বংশধর হাকিম খান সুরি। তা হলে মোগল বনাম রাজপুতদের যুদ্ধকে কী ভাবে হিন্দু বনাম মুসলমানের লড়াই বলা যায়?

Advertisement

রোমিলা থাপার প্রশ্নটা ছুড়লেন। এবং সেখানেই থামলেন না।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী থেকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বার বার ‘জাতীয়তাবাদ’-এর ধুয়ো তুলে নতুন করে ইতিহাস লেখার প্রয়োজনের কথা বলছেন। ইতিহাসে মোগলরা গুরুত্ব পেয়েছেন আর চোল-গুপ্ত- মৌর্য রাজারা উপেক্ষিত থেকে গিয়েছেন বলে অভিযোগ করে নতুন ইতিহাসে প্রাচীন ভারতের ‘গৌরবময় অতীত’ তুলে আনতে বলছেন।

Advertisement

শনিবার সন্ধ্যায় ইতিহাসবিদ রোমিলা থাপার দিল্লিতে ইউরোপের ইতিহাসবিদ এরিক হবসবমকে উদ্ধৃত করে বললেন, ইতিহাসের সঙ্গে জাতীয়তাবাদের সম্পর্ক আর আফিমের সঙ্গে হেরোইন আসক্তির সম্পর্কটা একই রকম। আফিমের নেশা যখন মাথায় চড়ে, মাদকাসক্ত তখন গৌরবময় অতীত নিয়ে রূপকথার জাল বোনে।

দিল্লির ইন্ডিয়া ইন্টারন্যাশনাল সেন্টারে সি ডি দেশমুখ স্মারক বক্তৃতায় রোমিলা থাপারকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। বিষয় ছিল ‘আমাদের ইতিহাস, তাদের ইতিহাস, কাদের ইতিহাস’। থাপারের বক্তৃতার আগে দিল্লির বিজেপি নেতা কপিল মিশ্র সোশ্যাল মিডিয়ায় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, দিল্লি পুলিশকে উল্লেখ করে অভিযোগ তোলেন, থাপারের বক্তৃতা শহরের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করবে। নেট দুনিয়ায় ইন্ডিয়া ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার কর্তৃপক্ষের কাছে বক্তৃতা বাতিল করার দাবিও ওঠে। কপিল অভিযোগ তোলেন, ‘‘রোমিলা থাপারের মতো ব্যক্তিরা মিথ্যা ইতিহাস লেখেন, ভুয়ো তথ্য দিয়ে হিন্দুদের গণহত্যার পক্ষে যুক্তি দেন। এই অনুষ্ঠানের লক্ষ্যও হল বিদ্বেষপূর্ণ মিথ্যা প্রচার।’’

হুঁশিয়ারির জেরে শনিবার সন্ধ্যায় অনুষ্ঠানের সময় বাড়তি নিরাপত্তার বন্দোবস্ত করা হয়েছিল। সেন্টারের সদস্য ও আমন্ত্রিত ছাড়া কাউকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। তা সত্ত্বেও বক্তৃতার সময় প্রেক্ষাগৃহে একটিও আসন খালি ছিল না। ভরা প্রেক্ষাগৃহে হাজির হয়ে ৯১ বছরের রোমিলা কার্যত তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগকারীদেরই পাল্টা জবাব দিয়েছেন। পেশাদার, প্রশিক্ষিত ইতিহাসবিদের সঙ্গে বানানো গল্প, রূপকথাকে ইতিহাস বলে চালানো বিভিন্ন দলের যে ফারাক রয়েছে, তা মনে করিয়ে দিয়েছেন। অমর্ত্য সেন সম্প্রতি কলকাতায় বৈদিক অঙ্কের গৌরবময় ঐতিহ্য নিয়ে মাতামাতি খারিজ করে দিয়ে বলেছেন, বৈদিক অঙ্ক বলে কিছুর অস্তিত্ব বিশ্বাস করা কঠিন। কারণ বেদে অঙ্ক খুবই সামান্য। রোমিলা দিল্লিতে বললেন, স্কুলে যে ইতিহাস পড়ানো হবে, তা নির্ভরযোগ্য তথ্যপ্রমাণভিত্তিক, প্রশিক্ষিত ইতিহাসবিদদের লেখা হওয়াটা জরুরি। জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের এমেরিটাস অধ্যাপক থাপার একই সঙ্গে মনে করিয়েছেন, স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় যে জাতীয়তাবাদ গোটা দেশকে এককাট্টা করেছিল, সবাইকে একটাই ভারতীয় পরিচিতি দিয়েছিল, তার সঙ্গে হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে বিভাজনকারী জাতীয়তাবাদের বিস্তর ফারাক রয়েছে। তাঁর স্পষ্ট কথা, ‘‘ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদ স্বাধীনতা অর্জনে একটিমাত্র আন্দোলনের লক্ষ্য নিয়েছিল। হিন্দু ও মুসলমান—দুই ধর্মের জাতীয়তাবাদ দেশ ভাগ করেছে। মুসলিমদের জন্য পাকিস্তান তৈরি হয়েছে। হিন্দুরা হিন্দুরাষ্ট্রের কিনারায় এগিয়ে যাচ্ছে। ঔপনিবেশিক পরিকল্পনাই সফল হচ্ছে।’’

মোদী-অমিত শাহরা বারবার মোগলদের ‘ধর্মান্ধ আক্রমণকারী’ বলে আখ্যা দেন। বিজেপি-আরএসএস মুঘল, সুলতান শাসকদের বিরুদ্ধে দেশের ‘হিন্দু সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য’ ধ্বংস করার অভিযোগ তোলে। বিরোধীদের দাবি, এই উস্কানিতেই অযোধ্যার পরে কাশী, মথুরায় মসজিদের জায়গায় মন্দির ছিল বলে সেখানে পুজোর দাবি উঠছে। কয়েক মাস আগে দিল্লির আদালতে কুতুব মিনার পরিসরেও পুজোর অনুমতি চেয়ে মামলা দায়ের হয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে রোমিলা বলেছেন, চতুর্দশ শতাব্দীতে কুতুব মিনার বাজ পড়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মেরামতির কাজে নেমে হিন্দু রাজমিস্ত্রিরা মিনারের গায়ে হিন্দিতে, ভুল সংস্কৃতে তাঁদের দেবতা বিশ্বকর্মা ও গণেশের কথা খোদাই করেছিলেন। যা থেকে প্রমাণ হয়, তাঁদের জোর করে কাজ করানো হচ্ছিল না। হিন্দুদের ধর্মান্তরণও হয়নি। কিন্তু এত বছর পরে সেই খোদাই করা অক্ষর দেখিয়ে হিন্দু সংগঠন বলছে, ওখানে আগে মন্দির ছিল। কুতুব মিনার আসলে নাকি ‘বিষ্ণু স্তম্ভ’!

‘লাভ জিহাদ’-এর তত্ত্ব নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন থাপার। প্রবীণ ইতিহাসবিদের যুক্তি, মোগলদের সঙ্গে রাজপুত পরিবারের বিয়ে হয়েছিল। ম্লেচ্ছদের পরিবারে বিয়ের জন্য রাজপুত শাসকদের কি মুখ পুড়েছিল? আপাত ভাবে না। সে সময় ‘লাভ জিহাদ’ ছিল না। এই সব বিয়ে জোর করে করা হয়েছিল, কোনও আত্মজীবনী বা স্মৃতিকথাও তেমন ইঙ্গিত দেয় না।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement