হাথরসে পোড়ানো হচ্ছে গণধর্ষিতা দলিত তরুণীর দেহ। পিটিআই
রাত তিনটে। অন্ধকারে ঢাকা রাস্তায় বসে হাহাকার করছেন কমলা শাড়ি পরা মহিলা। মাঝে মাঝে শাড়ির আঁচল বিছিয়ে দিচ্ছেন রাস্তায়। যেন ভিক্ষা চাইছেন। গণধর্ষিতা, নির্যাতিতা, নিহত মেয়ের দেহ একটি বার দেখতে চেয়ে ভিক্ষা।
হাথরসে গণধর্ষিতা দলিত কিশোরীর দেহ পরিবারের হাতে না দিয়ে তড়িঘড়ি পুড়িয়ে ফেলেছে উত্তরপ্রদেশ পুলিশ, আজ এই অভিযোগ করেছে নির্যাতিতার পরিবার। যোগী আদিত্যনাথের পুলিশ-প্রশাসন অবশ্য একাধিক বিবৃতি দিয়ে অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
কাল দিল্লির সফদরজং হাসপাতালে মেয়েটির মৃত্যুর পর থেকেই গোটা দেশে ক্ষোভের আগুন জ্বলছিল। আজ সকালে এই অভিযোগ সামনে আসার পরে সাধারণ মানুষ থেকে তাবড় রাজনীতিক— সোশ্যাল মিডিয়া আর সংবাদমাধ্যমে সকলেই ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন। যে ক্ষোভের আঁচ টের পেয়ে খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথকে ফোন করে ধর্ষকদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন। মুখ্যমন্ত্রীও তড়িঘড়ি তিন সদস্যের একটি বিশেষ তদন্তকারী দল (সিট) গঠন করেছেন। যার নেতৃত্ব দেবেন রাজ্যের স্বরাষ্ট্রসচিব ভগবান স্বরূপ।
আরও পড়ুন: ‘মুখ যাতে না খুলি, চাপ দেওয়া হচ্ছে’
ফাস্ট ট্র্যাক আদালতে যাতে এই মামলার বিচার হয়, সেই নির্দেশও দিয়েছেন আদিত্যনাথ। আগামী সাত দিনের মধ্যে রিপোর্ট জমা দেওয়ার নির্দেশও দিয়েছেন তিনি। তরুণীর বাবাকে আজ ফোন করেন মুখ্যমন্ত্রী। অভিযুক্তদের আগেই গ্রেফতার করা হয়েছে। দোষী চার যুবকের কঠোর শাস্তির দাবি করেছেন নির্যাতিতার বাবা। মুখ্যমন্ত্রী দ্রুত বিচারের প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন। রাতে মেয়েটির পরিবারকে ২৫ লক্ষ টাকা ‘এককালীন ক্ষতিপূরণ’ দেওয়া হবে বলে ঘোষণা করা হয়। দেওয়া হবে একটি বাড়ি।
আরও পড়ুন: এনকাউন্টার করে দিন, হাথরস নিয়ে যোগীকে আর্জি কঙ্গনার
কিন্তু কী হয়েছিল কাল মাঝরাতে? দিল্লির হাসপাতাল থেকে মেয়েটির দেহ নিয়ে প্রথমে হাথরসে তাঁর গ্রামের বাড়ির দিকে রওনা দেয় পুলিশের গাড়ি। অন্য গাড়িতে ছিলেন তাঁর পরিবারের লোক। জাতীয় সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিরাও পিছু নেন সেই গাড়ির। তাঁদের মধ্যেই এক মহিলা সাংবাদিক মাঝরাতে পর পর কয়েকটি টুইট করেন। ছবি আপলোড করে লেখেন, তাঁর ঠিক পিছনের মাঠেই যে চিতাটি জ্বলছে, সেটি সদ্য প্রয়াত তরুণীর। বাড়ির লোকের হাতে না দিয়েই পুলিশ তাঁর দেহ দাহ করে দিচ্ছে। ঘটনাস্থল তখন পুলিশ আর প্রশাসনিক আধিকারিকদের ভিড়ে থিকথিক করছে। ‘এখানে কী হচ্ছে’, অনেক বার জিজ্ঞেস করা সত্ত্বেও উত্তর দেননি এক পুলিশ আধিকারিক। সেই ভিডিয়ো-ও রয়েছে টুইটারে।
মেয়েটির এক দাদাও পরে জানান যে, তাদের গাড়ি বুল গরহি গ্রামে পৌঁছনোর অনেক আগেই পুলিশ বোনের দেহ নিয়ে সেখানে পৌঁছে গিয়েছিল। বাড়িতে না এনে দেহ সরাসরি নিয়ে যাওয়া হয় স্থানীয় শ্মশানে। গ্রামের মানুষ অ্যাম্বুল্যান্সের সামনে দাঁড়িয়ে বাধা দিলে খণ্ডযুদ্ধ বেধে যায়। আড়াইটে-পৌনে তিনটে নাগাদ পরিবারের বাকিদের বাড়িতে আটকে রেখে শুধুমাত্র তাঁর বাবাকে নিয়ে শ্মশানে যায় ৩০-৪০ জন পুলিশের একটি দল। নির্যাতিতা তরুণীর বাবাও আজ একই অভিযোগ করেছেন সংবাদমাধ্যমে ।
আরও পড়ুন: ফেসবুক-টুইটারে দিনভর চর্চায় হাথরস-বাবরি
হাথরসের জেলাশাসক অবশ্য বিবৃতি দিয়ে আজ জানিয়েছেন, পরিবারের অমতে মেয়েটিকে মোটেও দাহ করা হয়নি। তাঁর বাবা-দাদাদের অনুমতি নেওয়া হয়েছিল। মেয়েটির দেহ গাড়িতে রাত পৌনে একটা থেকে প্রায় আড়াইটে পর্যন্ত গ্রামেই রাখা ছিল। হাথরসের পুলিশ সুপার বিক্রান্ত বীরও বলেন, ‘‘যা হয়েছে, পরিবারের অনুমতি নিয়েই হয়েছে।’’ অথচ সাংবাদিকদের তোলা ভিডিয়োয় দেখা গিয়েছে, মা এবং পরিবারের কাকুতিমিনতির পরও পুলিশ অফিসারেরা বাড়িতে দেহ নেওয়ার অনুমতি দিচ্ছেন না, বরং বলছেন, সময়ের সঙ্গে রীতিনীতি বদলাতে হয়। বলছেন, দেহ আর রাখা যাবে না। পরিবারকে সেখানে সম্মতি দিতে দেখা যায়নি। আর দিনভর এই চাপানউতোরের মধ্যেই টিভির পর্দায়, বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টে বারবার ভেসে উঠছে মেয়ে-হারা মায়ের মুখ। হাউহাউ করে কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলছেন, ‘‘আমি শুধু এ-টুকু চেয়েছিলাম যে, আমাদের রীতি মেনে মেয়েটার শেষকৃত্য হোক। হলুদ লাগানোর রীতি রয়েছে আমাদের। আর কোনও দিন তো ওর গায়ে হলুদ মাখাতে পারব না। অন্তত একবার তো মেয়েটাকে আমাদের হাতে দিতে পারত!’’
না, পুলিশ দেহ দেয়নি। তবে বেঁচে থাকতে যে মেয়ে পুলিশের নিরাপত্তা পাননি, গভীর রাতে তাঁর ক্ষতবিক্ষত দেহ দাহ করেছে পুলিশ, নিজেদের গাড়ির ডিজেল ঢেলে আর তাঁর বাড়ি ঘিরেও আজ পুলিশের ‘কড়া’ প্রহরা!