ত্রিপুরা সরকারের সৌরভকে তাদের পর্যটনের ব্র্যান্ডদূত করার সিদ্ধান্ত একেবারেই ‘প্রশাসনিক’। — ফাইল চিত্র।
পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা ভোটের আগে একটা সময়ে উভয় পক্ষের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ ছিল। পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচনের পরে উভয় পক্ষের সম্পর্কে খানিকটা ‘শৈত্য’ এসেছিল। সেই বরফ কি খানিকটা গলল মঙ্গলবার? যখন বিজেপি শাসিত রাজ্য ত্রিপুরার পর্যটনের ব্র্যান্ডদূত হতে নীতিগত সম্মতি দিয়ে দিলেন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়? অনেকে মনে করছেন, অতটা এখনই বলাটা বাড়াবাড়ি হবে। তবে এটা বলাই যায় যে, উভয় পক্ষই পরস্পরকে বুঝিয়ে দিল, দরজা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়নি। পরে কোথাকার জল কোথায় গড়াবে এখনই বলা যাচ্ছে না। তবে পারস্পরিক সম্পর্কের দরজা খোলা আছে।
সৌরভকে ত্রিপুরা সরকার যে প্রস্তাব দিয়েছিল, তা তাদেরই ‘প্রশাসনিক’ সিদ্ধান্ত বলে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। কিন্তু এটাও ঠিক যে, বিজেপির সর্বোচ্চ স্তরের ‘অনুমোদন’ না-থাকলে তারা সেই প্রস্তাব দিত না। পক্ষান্তরে, সৌরভও জানতেন, তিনি বিজেপি শাসিত রাজ্যের ‘মুখ’ হওয়ার প্রস্তাবে রাজি হলে তা নিয়ে ‘রাজনৈতিক জল্পনা’ তৈরি হবে। ফলে মনে করা হচ্ছে, সৌরভও ভেবেচিন্তেই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ত্রিপুরা সরকারের প্রস্তাবে সম্মতি দিতে। এখন কথা হল, এই প্রস্তাব এবং সম্মতির পিছনে কী রয়েছে।
অনেকেই মনে করছেন, এটা দু’পক্ষের তরফেই একটা ‘বার্তা’। যে বার্তার নিহিত অর্থ হল, সম্পর্কের দরজা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়নি। তবে এ থেকে এই উপসংহারে পৌঁছনো অনুচিত হবে যে, সৌরভ বিজেপিতে যোগ দিয়ে ফেলবেন বা সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়বেন। সেটা নিয়ে কেউই নিশ্চিত নন। তবে বিজেপির একটি অংশের বক্তব্য, সৌরভের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক বরাবরই ‘আন্তরিক’ থেকেছে। তাদের আরও দাবি, ত্রিপুরা সরকারের সৌরভকে তাদের পর্যটনের ব্র্যান্ডদূত করার সিদ্ধান্ত একেবারেই ‘প্রশাসনিক’।
এখানে আরও একটি তথ্য প্রণিধানযোগ্য। আগামী অগস্টে পশ্চিমবঙ্গে রাজ্যসভার ভোট। এ বার বিজেপির যা বিধায়কসংখ্যা, তাতে তারা একটি আসনে নিশ্চিত জিতবে। সেই আসনে কি তারা সৌরভকে মনোনয়ন দেওয়ার প্রস্তাব করবে? তার চেয়েও বড় কথা, সৌরভ কি তাতে রাজি হবেন? তাঁর রাজনৈতিক বুদ্ধি ক্রিকেটীয় মস্তিষ্কের চেয়েও ক্ষুরধার বলে অনেকে মনে করেন। সে ক্ষেত্রে সৌরভ ওই ধরনের কোনও সিদ্ধান্ত নিতে গেলেও দীর্ঘ সময় ধরে ভাবনাচিন্তা করবেন।
বিজেপির অন্দরের খবর অনুযায়ী, রাজ্যসভার আসনে কাকে মনোনয়ন দেওয়া হবে, তা নিয়ে দলের অন্দরে দু’টি অভিমত রয়েছে। এক পক্ষ চাইছে, পুরোপুরি ‘রাজনৈতিক’ কাউকে মনোনয়ন দেওয়া হোক। যাকে ‘ভবিষ্যতের নেতা’ হিসাবে তৈরি করা হবে। অন্য একটি অংশের মতে, বাঙালি ‘অভিজাত’ (এলিট) সমাজের কাছে বার্তা দেওয়া যাবে, এমন কাউকে বেছে নেওয়া হোক। সে ক্ষেত্রে সৌরভের চেয়ে উপযুক্ত খুব বেশি কেউ নেই। এই অভিমত বহুদিন ধরেই বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব পোষণ করেন। এখন আবার দ্বিতীয়-তৃতীয় স্তরে এ নিয়ে একটা পর্যায়ে আলাপ-আলোচনা শুরু হয়েছে।
২০২১ সালের আগে সৌরভকে সরাসরি বাংলার বিধানসভা ভোটে তাদের ‘মুখ’ হওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল বিজেপি। বিভিন্ন টালবাহানা করে তিনি তখন পিছিয়ে যান। সৌরভের ঘনিষ্ঠদের দাবি, ভারতের প্রাক্তন ক্রিকেট অধিনায়ক প্রস্তাব দিয়েছিলেন, তিনি নির্বাচনে লড়তে চান না। তবে বিজেপির হয়ে প্রচার করতে পারেন। যদি পরে বিজেপি তাঁকে রাজ্যসভায় পাঠায়। কিন্তু অমিত শাহ তা মানতে রাজি হননি। তিনি-সহ বিজেপির শীর্ষনেতৃত্ব চেয়েছিলেন, সৌরভ বিজেপির হয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলের বিরুদ্ধে ভোটে লড়ুন। যদিও আনুষ্ঠানিক ভাবে কোনও পক্ষেই এর সত্যতা স্বীকার করা হয়নি। অসমর্থিত সূত্রের খবর, সৌরভকে রাজ্যসভায় মনোনয়ন চেয়েছিলেন। তাঁর পক্ষে সেই প্রস্তাব ছিল। বাংলার তৎকালীন ‘প্রভারী’ সৌরভের সঙ্গে কথা বলেছিলেন। কিন্তু সৌরভ রাজি হননি। বরং তাঁকে রাজ্যসভায় পাঠানো যায় কি না, তা ভেবে দেখার অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব তখন আর সেই প্রস্তাবে রাজি হননি।যদিও প্রকাশ্যে এ নিয়ে কোনও পক্ষই কখনও মুখ খোলেনি। এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে বরং এমন আলাপ-আলোচনার কথা উড়িয়ে দিয়েছে।
তার পর থেকে সৌরভের সঙ্গে বিজেপির ‘দূরত্ব’ তৈরি হয়েছে, এমন কথা কেউ না বললেও কেন্দ্রের শাসকদলের শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক যে বাড়তি ‘মসৃণ’ হয়েছে, তেমনও নয়। বরং অনেকেই মনে করেন, বিজেপির সঙ্গে সম্পর্কের ‘জটিলতা’র কারণেই সৌরভকে বিসিসিআইয়ের সভাপতির পদ হারাতে হয়েছে। যে পদ, ক্রিকেটমহলের অনেকেই জানেন, শেষমুহূর্তে তিনি পেয়েছিলেন বিজেপি শীর্ষনেতৃত্বের বদান্যতায়।
তার পরে গঙ্গা দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গিয়েছে। অনেকে মনে করছেন, বিজেপি নেতৃত্বর মনোভাব বদলেও বদলে থাকতে পারে। তবে সৌরভ-বিজেপি সম্পর্ক প্রকাশ্যে ‘আন্তরিক’ই থেকেছে। শাহ তাঁর কলকাতা সফরে বিজেপির রাজ্যনেতাদের নিয়ে সৌরভের বাড়িতে নৈশভোজে গিয়েছেন। অন্য দিকে, তৃতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর ২০২১ সালের ৮ জুলাই সৌরভের জন্মদিনে তাঁর বাড়িতে গিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা। ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে অসুস্থ সৌরভের জন্য বেহালার স্থানীয় কাউন্সিলরকে দিয়ে ফল, মিষ্টি, শুভেচ্ছাবার্তা এবং ফুল পাঠিয়েছিলেন তিনি। অমিত শাহ সৌরভের বাড়িতে যান ২০২২-এর ৬ মে। যে কোনও কারণেই হোক, তার পরে মুখ্যমন্ত্রী আর মহারাজের বাড়িতে যাননি। কিন্তু, শাহি-সাক্ষাতের পরের দিনই, ৭ মে, বাইপাসের ধারে এক বেসরকারি হাসপাতালের অনুষ্ঠানে এক মঞ্চে ছিলেন রাজ্যের মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম এবং সৌরভ। সেখানে সৌরভ বলেন, “মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আমার কাছের মানুষ।”
তার এক বছর পরেই এই ‘মোচড়’। ত্রিপুরার পর্যটনমন্ত্রী সুশান্ত চৌধুরী জানিয়েছেন, আইপিএল চলাকালীনই তাঁরা সৌরভের সঙ্গে যোগাযোগ করে ওই প্রস্তাব দিয়েছিলেন। সৌরভ তখনই নীতিগত সম্মতি দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি দিল্লিতে থাকায় বিষয়টি বাস্তবায়িত হয়নি। তাঁর দলের আইপিএল অভিযান শেষ হওয়ার পর সৌরভ কলকাতায় ফেরামাত্রই ত্রিপুরার পর্যটনমন্ত্রী সুশান্ত তাঁর দফতরের আধিকারিকদের নিয়ে মঙ্গলবার সৌরভের বাড়িতে যান। ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী মানিক সাহার সঙ্গেও সৌরভের একপ্রস্ত কথা হয় ফোনে। তার পরেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানানো হয়। জুনের প্রথম দিকে সৌরভের লন্ডনে যাওয়ার কথা। তিনি ফিরলে তাঁর ব্র্যান্ডদূত হওয়ার বিষয়টি খাতায়কলমে মিটিয়ে ফেলবে ত্রিপুরা সরকার। তার পরে সৌরভ ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলায় যেতে পারেন।
ত্রিপুরা সরকারের প্রস্তাব সৌরভ মেনে নেওয়ায় বিজেপির একটি অংশের নেতারা মনে করছেন, সৌরভকে ত্রিপুরা সরকারের ব্র্যান্ডদূত নিয়োগ করা হয়েছে, এই তথ্যের চেয়েও যেটা বড় করে দেখানো গিয়েছে, তা হল— বাংলার মহারাজকে পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাদের ব্র্যান্ডদূত নিয়োগ করেনি! বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদারের কথায় সেটা আরও স্পষ্ট। যিনি বলেছেন, ‘‘বাংলায় অনেক কৃতী এবং যশস্বী মানুষ রয়েছেন। যাঁরা সর্বভারতীয় ক্ষেত্রেও বিখ্যাত। সৌরভ তাঁদেরই একজন। কিন্তু তাঁকে রাজ্যের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর নিয়োগ না করে শাহরুখ খানকে বাইরে থেকে এনে ব্র্যান্ডদূত করা হয়েছে! উনি তো বহিরাগত।’’
যদিও অনেকেই বলছেন, এর মধ্যে রাজনীতি খোঁজা অর্থহীন। ত্রিপুরা বাংলার ক্রিকেটার ঋদ্ধিমান সাহাকে নিয়েছে তাদের রাজ্যদলকে শক্তিশালী করার জন্য। তারা সেই দলের ডিরেক্টর করে আনতে চাইছে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রাক্তন অলরাউন্ডার ল্যান্স ক্লুজনারকে। সেটা যেমন একেবারেই ক্রিকেটীয় কারণে, সৌরভকে ব্র্যান্ডদূত করার সিদ্ধান্তও তেমনই ‘ত্রিপুরা’ ব্র্যান্ডকে আরও শক্তিশালী করার জন্য।
এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক ভাবে কেউই মুখ খুলতে চাইছেন না। সৌরভ তো নয়ই। রাজ্য বিজেপির প্রধান মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্যের দাবি, ‘‘এটি সম্পূর্ণ ত্রিপুরা সরকারের প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত। সৌরভের গ্রহণযোগ্যতাকে যদি বাংলাভাষী রাজ্য কাজে লাগায়, সেটা তো আনন্দের বিষয়।’’
সৌরভ বিজেপি শাসিত ত্রিপুরার ব্র্যান্ডদূত হওয়ার বিষয়টির উপরে তৃণমূলও যে একেবারে নজর রাখছে না, তা নয়। তবে এটি এমনই একটি সিদ্ধান্ত, যা নিয়ে তারা সৌরভের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কিছু বলতেও পারছে না। তবে দলের রাজ্য সম্পাদক তথা মুখপাত্র কুণাল ঘোষ ‘তাৎপর্যপূর্ণ’ মন্তব্য করেছেন, ‘‘সৌরভ বরাবরই ভাল অলরাউন্ডার। তিনি কোনও মাঠে ব্যাট ধরেন, কোনও মাঠে বল।’’