তাঁত ছেড়ে আইআইটি, স্বপ্ন বুনছে পাটোয়ার গ্রাম

তাঁতির মেয়ে রূপা নতুন করে বুনতে শুরু করেছেন। কাপড় নয়, স্বপ্ন। গয়ার মানোয়া ব্লকের পাটোয়া গ্রামের মেয়েটি এই প্রথম গয়ার বাইরে যাবেন। বাবা-মাকে ছেড়ে এই প্রথম একা থাকবেন।

Advertisement

দিবাকর রায়

গয়া শেষ আপডেট: ১০ জুলাই ২০১৫ ০৪:০৯
Share:

তাঁতির মেয়ে রূপা নতুন করে বুনতে শুরু করেছেন। কাপড় নয়, স্বপ্ন।

Advertisement

গয়ার মানোয়া ব্লকের পাটোয়া গ্রামের মেয়েটি এই প্রথম গয়ার বাইরে যাবেন। বাবা-মাকে ছেড়ে এই প্রথম একা থাকবেন। তাই নিয়ে যেমন এক দিকে উদ্বেগ, তেমনই গ্রামের প্রথম মেয়ে হিসেবে আইআইটির দরজায় পা দিতে চলেছেন তিনি, তা নিয়ে এক ধরনের শিহরনও। রূপার কথায়, ‘‘আগে ভয় করছিল পরীক্ষায় পাশ করব কী ভাবে। আর এখন ভয় করছে বাড়ির সকলকে ছেড়ে থাকব কী করে!’’ রূপা কুমারীই একা নন, এ বারে পাটোয়া গ্রাম থেকে একসঙ্গে ১২ জন বিভিন্ন আইআইটিতে
যোগ দেবেন।

গয়া পুরসভা যেখানে শেষ হচ্ছে, ঠিক সেখানেই শুরু মানপুর ব্লক। ঝকঝকে রাস্তার পাশে সাজানো-গোছানো পাটোয়া গ্রাম। আধুনিক সব ব্যবস্থাই প্রায় রয়েছে গ্রামে। পার্ক স্ট্রিটের থেকেও বেশি কার্যকর ওয়াই-ফাই। বিভিন্ন ব্যাঙ্কের একাধিক এটিএম। পাঁচ হাজার জনবসতির গ্রামটিতে যে ইঞ্জিনিয়ারের সংখ্যাই তিনশোর বেশি। তার মধ্যে ষাট জনই তো আবার ‘আইআইটিয়ান’। দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে তাঁরা। সুতরাং গ্রামীণ এলাকাতেও বসাতে হয়েছে ওয়েস্টার্ন ইউনিয়নের পরিষেবা।

Advertisement

গ্রামের বেশির ভাগ মানুষই পাটোয়ারি বা তাঁতি সম্প্রদায়ের। বিহারের জাতপাতের নিরিখে পিছড়ে বর্গের মানুষ। কিন্তু সেই পিছড়ে বর্গের গ্রাম এখন জাতি-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষের গর্বের কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। রাজ্যের ‘আইআইটি হাব’ হিসেবে নিজেদের গ্রামকে তুলে ধরেছেন পাটোয়ার মানুষ। শুধুই জাল সার্টিফিকেট, গণটোকাটুকি, দীর্ণ শিক্ষা ব্যবস্থার কথা বলে যারা বিহারকে চিহ্নিত করে, তাদের ‘মুহ্‌তোড়’ জবাব তো পাটোয়াই।

গ্রামে ঢোকার মুখেই সঙ্কটমোচনের মন্দির। মন্দিরের সামনেই দেখা গ্রামের বাসিন্দা সীতারামের সঙ্গে। সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে হাসিমুখে ডেকে নিলেন সীতারামজি। চিনি ছাড়া দার্জিলিং চায়ের অর্ডার দিয়ে গ্রামের ছেলেমেয়েদের সাফল্যের কথা বলতে শুরু করলেন তিনি। সীতারামের কথায়, ১৯৯১ সালে এই গ্রাম থেকে প্রথম আইআইটি-র দরজায় পা দেন জিতেন্দ্র। এখন বড় চাকরি করেন আমেরিকায়। ছুটি পেলে গ্রামে আসেন। জিতেন্দ্রর পরে ১৯৯৮ সালে একসঙ্গে গ্রামের তিন জন ফের আইআইটিতে পড়ার সুযোগ পায়। এর পরেই সিনিয়র দাদাদের পরামর্শে পাটোয়ারি তরুণরা নিজেদের স্টাডি সার্কল তৈরির সিদ্ধান্ত নেন। ছোটদের পড়া তৈরির কাজে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে বড়রা। শুরু হয় ‘আইআইটি বিপ্লব’। তার পরে আর ফিরে তাকাতে হয়নি। পরের বছরই সাত জন আইআইটিতে যোগ দেয়।

সবাই জানতে চান, সাফল্যের চাবিকাঠিটি কী? এ কি স্থানমাহাত্ম্য? হাসেন গ্রামবাসী অঞ্জন কুমার। জানান কোনও ম্যাজিক নয়, স্রেফ মনের জোর ও স্থির লক্ষ্যই সাফল্যের মূল চাবিকাঠি। পাশাপাশি, নিজের মাটির প্রতি অপার ভালবাসা। উচ্চশিক্ষা গ্রামের ছেলেদের গ্রাম থেকে আলাদা করে দেয়নি। তাঁরা বারে বারেই ফিরে আসেন, পাটোয়ার দিকে বাড়িয়ে দেন সহায়তার হাত।

সীতারামজি বলতে থাকেন, এর পরেই গ্রামের তরুণরা মিলে একটি স্টাডি সার্কল চালাতে শুরু করে। সেখানেই আইআইটি-সহ বিভিন্ন এন্ট্রান্স পরীক্ষার প্রস্তুতি-রীতি শেখানো হয়। একাদশ শ্রেণি থেকেই গ্রামের সব ছাত্রছাত্রী সেই সার্কলে যোগ দেয়। নিজেদের মধ্যে মত বিনিময় করে। কী ভাবে আরও ভাল করা যায় তা নিয়ে দেশের বিভিন্ন আইআইটি-তে পাঠরত ‘সিনিয়র’দের সাহায্য নেয়। ফেসবুক আর হোয়াটসঅ্যাপে গ্রুপ তৈরি করেও আলোচনা চলে পদার্থবিদ্যা, রসায়ন আর অঙ্ক নিয়ে।

চলতি বছরে অবশ্য পাটোয়া গ্রামের বাইরের কিছু ছেলেমেয়েকেও স্টাডি সার্কলে নেওয়া হয়েছিল। বহিরাগত রাহুল কুমার ও রাহুল সিংহও এ বার আইআইটি-র সফল তালিকায় ঠাঁই করে নিয়েছে। স্টাডি সার্কলের কর্তা গোপাল কুমার পাটোয়া বলেন, ‘‘আজ এই গ্রামকে যেমন দেখছেন, দশ বছর আগেও এমন ছিল না। বস্তি এলাকা ছিল। সেই অবস্থা থেকে গ্রামের এই পরিবর্তন হয়েছে ছেলেমেয়েদের জন্যই। ওরা ভাল পড়াশোনা করেছে। বড়় বড় কোম্পানিতে যোগ দিয়েছে। গ্রামের উন্নতিতেও সাহায্য করছে।’’ গোপাল জানিয়েছেন, গ্রাম থেকে প্রায় ৩০০ ছেলেমেয়ে ইঞ্জিনিয়ার হয়েছেন। যাঁদের মধ্যে ৫৮ জন ভারতীয় আইভি লিগ তথা আইআইটি-র ছাত্র।

এক সময়ে তাঁতের জন্য বিখ্যাত ছিল মানপুর। লোকে বলত পূর্ব ভারতের ম্যানচেস্টার। কথিত আছে, চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যর আমল থেকে রাজাদের জন্য কাপড় বুনেছেন পাটোয়ার তাঁতিরা। পড়াশোনায় সে ভাবে তাঁরা মন দেননি কখনও। গত ১৫ বছরে পাওয়ার লুমের বাড়বাড়ন্ত আর বাজারে তাঁতজাত পণ্যের দুর্দশা দেখে বাবা-মায়েরা ছেলেমেয়েদের নিজেদের পেশা থেকে সরিয়ে দিচ্ছেন। পড়াশোনা করে দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে পড়েছেন পাটোয়ার তরুণ-তরুণীরা। আর তাঁরাই বদলে দিয়েছেন গোটা এলাকার ছবি। সব দেখেশুনে গয়ার জেলাশাসক সঞ্জয় অগ্রবালের বক্তব্য, ‘‘এই ‘পাটোয়া মডেল’ দেশের পিছিয়ে পড়া এলাকায় চালাতে পারলে সাফল্য আসবেই। দেখা যাক। সরকারের কাছে প্রস্তাব পাঠাচ্ছি।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement