বাঁ দিক থেকে, বারাণসীর জ্ঞানবাপী মসজিদএবং কাশী বিশ্বনাথ মন্দির। — ফাইল চিত্র।
ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ (আর্কিয়োলজিকাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া বা এএসআই)-এর বিশেষজ্ঞদের পাশাপাশি এ বার বারাণসীর জ্ঞানবাপী মসজিদে ‘বৈজ্ঞানিক সমীক্ষা’র কাজে যোগ দিলে কানপুর আইআইটির প্রযুক্তিবিদেরাও। শুক্রবার সকাল থেকে শুরু হয়েছে অষ্টম দিনের সমীক্ষার কাজ। আনা হয়েছে গ্রাউন্ড পেনিট্রেটিং রাডারও।
গত মাসে সুপ্রিম কোর্ট এবং ইলাহাবাদ হাই কোর্টে শুনানিপর্বে মুসলিমপক্ষের আইনজীবী বলেন, ‘‘এএসআই সমীক্ষা হলে হাজার বছরের পুরনো ঐতিহাসিক স্থাপত্য ভেঙে পড়তে পারে।’’ প্রসঙ্গত, সোমবার শীর্ষ আদালতে এএসআই স্পষ্ট ভাবে জানিয়েছিল, কোনও খনন না করে ‘গ্রাউন্ড পেনিট্রেটিং রাডার’-এর সাহায্যে তারা সমীক্ষা চালাতে সক্ষম। এর ফলে মসজিদের বিন্দুমাত্র ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা নেই। প্রসঙ্গত, গত ২১ জুলাই বারাণসী জেলা আদালতের বিচারক অজয়কুমার বিশ্বেস জ্ঞানবাপী চত্বরে ‘বৈজ্ঞানিক সমীক্ষার’ নির্দেশ দিয়েছিলেন এএসআই-কে। তবে বিতর্কিত ওজুখানায় পাওয়া তথাকথিত ‘শিবলিঙ্গ’ এবং সন্নিহিত ‘সিল’ করা এলাকায় এখনই কোনও সমীক্ষা হবে না বলে বারাণসী জেলা আদালত জানায়।
‘অঞ্জুমান ইন্তেজামিয়া (জ্ঞানবাপী) মসজিদ কমিটি’-র তরফে ইলাহাবাদ হাই কোর্টে বৈজ্ঞানিক সমীক্ষার রিপোর্ট মুখবন্ধ খামে বারাণসী জেলা আদালতে পেশ করার আবেদন জানানো হলেও তা খারিজ হয়ে যায়। বৃহস্পতিবার বিচারক বিশ্বেস অবশ্য ওই রিপোর্ট সংক্রান্ত কোনও খবর প্রকাশ না করার নির্দেশ দিয়েছেন সাংবাদমাধ্যমকে। এই পরিস্থিতিতে শুক্রবার আবার মসজিদ কমিটির তরফে এএসআই সমীক্ষা বন্ধের জন্য নতুন করে বারাণসী জেলা আদালতে আবেদন জানানো হয়েছে।
প্রসঙ্গত, ২০২১ সালের অগস্টে পাঁচ হিন্দু মহিলা জ্ঞানবাপীর ‘মা শৃঙ্গার গৌরী’ (ওজুখানা ও তহখানা নামে পরিচিত) এবং মসজিদের অন্দরের পশ্চিমের দেওয়ালে দেবদেবীর মূর্তির অস্তিত্বের দাবি করে তা পূজার্চনার অনুমতি চেয়ে যে মামলা দায়ের করেছিলেন তারই প্রেক্ষিতে মসজিদের অন্দরের ভিডিয়ো সমীক্ষা করার নির্দেশ দিয়েছিলেন বারাণসীর নিম্ন আদালতের বিচারক রবিকুমার দিবাকর। এর পরেই হিন্দু পক্ষের তরফে প্রাপ্ত নমুনাগুলির কার্বন ডেটিং পরীক্ষার আবেদন জানানো হয় গত ২২ সেপ্টেম্বর।
সেই সমীক্ষা এবং ভিডিয়োগ্রাফির কাজ শেষ হওয়ার পরে গত ২০ মে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে মামলার শুনানির দায়িত্ব পায় বারাণসী জেলা আদালত। পর্যবেক্ষক দলের ভিডিয়োগ্রাফির রিপোর্টে মসজিদের ওজুখানার জলাধারে শিবলিঙ্গের মতো আকৃতির যে কাঠামোর খোঁজ মিলেছে, সেটি আসলে ফোয়ারা বলে মুসলিম পক্ষ দাবি করে। অন্য দিকে, হিন্দুপক্ষের তরফে প্রাপ্ত নমুনাগুলির কার্বন ডেটিং পরীক্ষার আবেদন জানানো হয় গত ২২ সেপ্টেম্বর।
‘শিবলিঙ্গে’র বয়স নির্ধারণে কার্বন ডেটিং পদ্ধতির প্রয়োগ নিয়ে অবশ্য ধন্দ রয়েছে বিশেষজ্ঞদের একাংশের মধ্যে। তাঁরা জানাচ্ছেন, কার্বন ডেটিংয়ের মাধ্যমে মূলত জীবাশ্ম বা দেহাবশেষের বয়স নির্ধারণ করা হয়। পরিবেশে কার্বনের সবচেয়ে বেশি যে আইসোটোপ পাওয়া যায় তা হল কার্বন-১২। সেই সঙ্গে খুব অল্প পরিমাণ কার্বন-১৪-ও পাওয়া যায়। ওই পরিবেশে এই দুই আইসোটোপের অনুপাত প্রায় স্থির।
বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, প্রাণী বা উদ্ভিদ পরিবেশ থেকে এই দুই ধরনের কার্বন আইসোটোপই গ্রহণ এবং ত্যাগ করে। মৃত্যুর পরে সেই প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়। ৫,৭৩০ বছর পরে কার্বন-১৪ আইসোটোপের পরিমাণ অর্ধেক হয়ে যায়। বৈজ্ঞানিক ভাষায় যার নাম ‘হাফ লাইফ’। ফলে প্রাণী বা উদ্ভিদের ক্ষেত্রে মৃত্যুর পরে কার্বনের এই দুই আইসোটোপের অনুপাত বদলায়। কার্বন ডেটিং পদ্ধতিতে সেই পরিবর্তনের হিসাব করে ওই প্রাণী বা উদ্ভিদের মৃত্যুর আনুমানিক সময় নির্ধারণ করা সম্ভব।
কিন্তু পাথর বা শিলার মতো বস্তুর ক্ষেত্রে এ ভাবে বয়স নির্ধারণ কঠিন বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞদের একাংশ। অনেক ক্ষেত্রে কোনও প্রাচীন শিলা বা প্রস্তরখণ্ডের নীচে চাপা পড়ে থাকা প্রাণী বা উদ্ভিদের দেহাবশেষ পরীক্ষা করে তার বয়স নির্ধারণের চেষ্টা করা হয়। সে ক্ষেত্রে গ্রাউন্ড পেনিট্রেটিং রেডার ব্যবহারেরও প্রচলন রয়েছে। কিন্তু জ্ঞানবাপীর মতো প্রাচীন ওই ঐতিহাসিক কাঠামোর এমন পরীক্ষা উচিত কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। বারাণসী জেলা আদালতের নির্দেশেও সুনির্দিষ্ট ভাবে ‘কার্বন ডেটিং পরীক্ষা’র কথা জানানো হয়নি।