আতঙ্কে বঙ্গের পরিযায়ীরা
Communal Violence

‘হাঁসুয়া নিয়ে শাসানোর পর ঘুম আসে না’

ওই নিমগাছের সামনে কোনও জনপ্রাণী না দেখে গেটে বার বার ধাক্কা মারতে বোঝা গেল, তালা লাগানো রয়েছে।

Advertisement

অগ্নি রায়

গুরুগ্রাম শেষ আপডেট: ০৬ অগস্ট ২০২৩ ০৯:৫৪
Share:

—ফাইল চিত্র।

অ্যাসবেস্টস শিট-এর পলকা গেটের ও পারে কোনও সাড়াশব্দ নেই। এ পারে গায়ে কাঁটা দেওয়া নির্জনতা। মাঝে একলা হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে বিরাট নিমগাছ। যার চারপাশের বাঁধানো চত্বর একেবারেই জনশূন্য। এখান থেকে বৃষ্টিতে সামান্য কর্দমাক্ত হয়ে থাকা কিলোমিটার খানেক পথ হেঁটে গেলে গুরুগ্রামের অত্যাধুনিক মহাসড়কে দৌড়চ্ছে অমৃতকালের নতুন ভারত। নিকটবর্তী খুচরো আতঙ্কের জন্য তার মাথাব্যথা বিশেষ নেই।

Advertisement

‘‘মনটাকে কিছুতেই বুঝ দিতে পারছি না। পুলিশ এসে বলেছে যে যারটা দেখে নাও, তোমাদের সুরক্ষা দিতে পারব না। বলছে, আমাদেরই নিরাপত্তা নেই, তোমাদের আর কী দেব!” বলছেন নদিয়ার নাকাশিপাড়া এলাকার খুরশেদ আলি। তাঁর প্রশ্ন, “হাঁসুয়া, রড নিয়ে এসে শাসিয়ে যাওয়ার পর আর ঘুম আসে বলুন?”

ওই নিমগাছের সামনে কোনও জনপ্রাণী না দেখে গেটে বার বার ধাক্কা মারতে বোঝা গেল, তালা লাগানো রয়েছে। ভিতরে পশ্চিমবঙ্গ থেকে পেটের দায়ে আসা আসা মানুষের বস্তি। গুরুগ্রামের ৭০-এ সেক্টরের পরিত্যক্ত পেটে এই বস্তি, যে সেক্টরের দিগন্ত দেখা যায় না আকাশ-আঁচড়ানো বহুতলের মেলায়। ঠিকাদারকে মাসে মাসে কিছুটা টাকা দিয়ে টিনের চালে এখানে প্রায় শ’দুয়েক পরিবারের দিন গুজরান। হরিয়ানার নুহতে শুরু হওয়া অশান্তি ছড়িয়ে পড়ার পরে এখানেই এসে শাসিয়ে গিয়েছিল নিজেদের বজরং দল বলে পরিচয় দেওয়া বাইকবাহিনী। তাদের আস্ফালন যে ফাঁকা নয় তা বোঝাতে ফেরার পথে অদূরের একটি-দু’টি বাতিল লোহালক্করের দোকানে পেট্রল ঢেলে জ্বালিয়েও গিয়েছিল সে দিন। এরপর বস্তিবাসী এই গেট আর সহজে খুলছেন না।

Advertisement

বেশ কিছু ক্ষণ ধাক্কার পরে গেট সামান্য ফাঁক হল। ও পারে যে দৃষ্টি, তা আতঙ্কে বিস্ফারিত। সম্ভবত অতিথি মাত্র এক জন এবং তিনি নিরস্ত্র বুঝে অল্প ফাঁক হল দরজা। একটু বাংলায় কথার পর, ফাঁক আরও একটু চওড়া।

“নিজের দেশে পেটের জোগান করতে পারলে কি আর এত দূরে এসে পড়ে থাকি? এখানে দিনে এক বাড়িতে সাফ-সাফাইয়ের কাজ সেরে সন্ধ্যায় একটা কারখানায় জোগাড়ের কাজ করি। তিন বছরে কিছু টাকাও জমিয়েছি। কিন্তু এখন যা হচ্ছে, সেই ভয় তো কোভিডের সময়েও হয়নি,” মুখ খুলেছেন মালদহের গাজল থানার শামসেদ আলি। দিনদুপুর ফুঁড়ে খান চল্লিশেক বাইক এসে ঢুকেছিল এই কলোনিতে, যেখানে একশো ষাটঘর মুসলমানের, বাকি খান চল্লিশ হিন্দুর। সবাই কাজে ধান্দায় সকালেই বেরিয়ে যান বউ-বাচ্চাদের রেখে। রাতে ফিরে সেলিম শেখ, বিকাশ মণ্ডল, নীতীশ সিংহরা একসঙ্গে খাটিয়ায় বসে বিড়িতে ভাগ করে টান দেন। তাঁদের সুখদুঃখের গল্পে জড়িয়ে যায় ধোঁয়ার ওম।

এ হেন শান্তির জায়গায় এমন ‘দাবাং’ এঁরা অন্তত কেউ দেখেননি তিন-চার বছরের প্রবাসী জীবনে। শামশেদ-সেলিমরা বলছেন, “র়ড দেখিয়ে বলে, এখানকার সব মুসলমান জায়গা খালি করো, বিকেল চারটে অব্দি সময় দিচ্ছি। নয়তো আগুন লাগবে। পুলিশের গাড়ি কিন্তু একটু পরে এসে ঠায় দাঁড়িয়েছিল ওই নিমগাছের তলে। তার আর নড়াচড়া নেই। আমরা ভয়ে কাঠ। অনেকেই তখনই গাঁঠরি বেঁধে হাঁটা দিল, কেউ কেউ তৎকালে টিকিট কাটার চেষ্টায়। আমাদের হাতে টাকা নেই কোথায় যাব? আবার সাতটার সময় ওরা এল, সংখ্যায় কম, ভিতরেও ঢোকেনি। বাইরে থেকে হাঁকডাক করে জানতে চাইল আমরা চলে যাচ্ছি কি না। এখানকার হিন্দু ভাইরাই গেটে গিয়ে সামলাল। বলল, সব যাচ্ছে একে একে। তারপর আর আসেনি। কিন্তু আমরা রাতে ঘুমোতে পারি না।”

আপাতত এঁরা নিজেদের তৈরি করা জেলখানায় এ ভাবেই বন্দি। যত লোক পালাচ্ছে, ততই ভয় বাড়ছে বাকিদের। অবস্থা এমন রাতে হাত থেকে সামান্য বাসন পড়ার আওয়াজ হলেও বাকিরা ছুটে আসছেন। পুরনো বাড়িগুলিতে যাঁরা ঠিকে কাজ করতেন, সেই সব আবাসনের অনেকগুলিই কড়া ভাবে নিষেধ করে দিয়েছে আসতে। তাঁদের কাছে না কি ফোন এসেছে। দক্ষিণ দিনাজপুরের সামসুল মিঞার কথায়, “আসলে ওই আগুন লাগানো দেখেই আমাদের ভয়ের শুরু। সেই একই হুমকি আমাদেরও দিয়েছে তো। যদি চড়-থাপ্পড় মেরে চলে যেত, সে রকম ভয়ের কিছু ছিল না। এখানে অনেকের কোলে বাচ্চা। আগুন লাগালে কে কাকে সামলাবে?”

আতঙ্ক এবং পরিস্থিতি কোন পর্যায়ে গেলে মানুষ যে এতটাই হীনবল হয়ে যেতে পারে, তা বার বার দেখেছে এই দেশ। গুরুগ্রাম সেই মানচিত্রে নতুন সংযোজন মাত্র।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement