gulabo sapera

জন্মের পর পুঁতে ফেলা হয়েছিল, পোষা সাপেদের কাছে ‘নাচ’ শিখে বিশ্বনন্দিত এই সাপুড়েকন্যা

এই যাযাবর গোষ্ঠীতে সে সময় প্রচলিত নিয়ম ছিল, বেশি কন্যাসন্তানকে স্থান দেওয়া হবে না। সমাজের পঞ্চায়েতের নিয়মে কোনও দম্পতি বেশি কন্যাসন্তানের জন্ম দিলেই নবজাতকদের মেরে ফেলতে হত।

Advertisement
নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ৩১ ডিসেম্বর ২০২০ ১৬:০৫
Share:
০১ ২০

ঘাসজমি, নাকি তার ইচ্ছাশক্তি, কোন জাদুতে জীবন্ত অবস্থায় মাটির নীচে বেঁচেছিলেন তিনি? জানেন না আজও। শুধু জানেন মা আর কাকিমা মিলে ঘাসজমি খুঁড়ে তুলে এনেছিলেন তাঁকে। তখন তাঁর বয়স ১ দিনেরও কম। মাটির তলায় ছিলেন ৭ ঘণ্টা।

০২ ২০

নতুন জন্ম পাওয়া সে দিনের নবজাতকের পরিচয় আজ গুলাবো সপেরা। রাজস্থানি সাপুড়েদের নাচকে তিনি নিয়ে গিয়েছেন বিশ্বদরবারে। রাজস্থানি তথা ভারতীয় লোকনৃত্যের অন্যতম মুখ আজ এই শিল্পী।

Advertisement
০৩ ২০

রাজস্থানের এক যাযাবর গোষ্ঠী হল কালবালিয়া। কয়েকশো বছর ধরে তাঁরা পেশাগতভাবে সাপুড়ে। ‘কাল’ অর্থাৎ বিষ মিশে গিয়েছে তাঁদের পরিচয়েও। সেই জনগোষ্ঠীতে ১৯৭৩ সালে জন্ম গুলাবোর। তিনি বাবা মায়ের চতুর্থ কন্যাসন্তান।

০৪ ২০

এই যাযাবর গোষ্ঠীতে সে সময় প্রচলিত নিয়ম ছিল, বেশি কন্যাসন্তানকে স্থান দেওয়া হবে না। সমাজের পঞ্চায়েতের নিয়মে কোনও দম্পতি বেশি কন্যাসন্তানের জন্ম দিলেই নবজাতকদের মেরে ফেলতে হত।

০৫ ২০

অজমেঢ়ের কোটড়া গ্রামে গুলাবোর যখন জন্ম হয়, সে সময় তাঁর বাবা গিয়েছেন দূর গ্রামে, সাপের খেলা দেখাতে। যখন ফিরেছেন, তখন তাঁর সদ্যোজাত কন্যাসন্তানের জায়গা হয়েছে মাটির নীচে। শোনা যাচ্ছে তার কান্নার শব্দ।

০৬ ২০

প্রচলিত রীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন গুলাবোর বাবা। জেদ করে তুলিয়ে এনেছিলেন মেয়েকে। তিনি মেনে নিতে পারেননি শুধুমাত্র মেয়ে হওয়ার ‘অপরাধে’ নবজাতক হত্যা। তাঁর বিরুদ্ধাচারণের জন্য গোটা কালবেলিয়া সমাজ তাঁকে একঘরে করেছিল।

০৭ ২০

তাতে কিছু এসে যায়নি নির্ভীক সাপুড়ের। তিনি সদ্যোজাত কন্যাকে ঘরে এনেছিলেন। নাম দিয়েছিলেন ধনবতী। ১ বছর বয়সে এক বার গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছিল সেই শিশু। চিকিৎসকরা আশা ছেড়েই দিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁদের আশঙ্কা ভুল প্রমাণ করে সুস্থ হয়ে ওঠে সে।

০৮ ২০

চিকিৎসকের চেম্বারে মেয়ের পাশে একটি গোলাপফুল পড়ে ছিল। কোনওভাবে ধনবতীর বাবার মনে হয়, ওই ফুল শুভ। তাঁর মেয়ে নতুন জীবন পেয়েছে ফুলের জন্যই। তিনি মেয়ের নতুন নাম দেন গুলাবি। পরে সংবাদমাধ্যমে তাঁর পরিচয় প্রকাশিত হয় ‘গুলাবো’ বলে। সেই থেকে তিনি ‘গুলাবো’ নামেই বিখ্যাত।

০৯ ২০

মাত্র ৬ মাস বয়স থেকে গুলাবোকে সঙ্গে নিয়ে সাপের খেলা দেখাতে যেতেন তাঁর বাবা। তাঁর বাঁশির নড়াচড়া অনুযায়ী সাপের মাথা দুলত। সরীসৃপের সেই গতি অনুসরণ করে দুলত ছোট্ট শিশুও।

১০ ২০

সেই শুরু। সাপের দুলুনি অনুসরণ করে করে গুলাবো হয়ে উঠলেন ‘সপেরা নৃত্যশিল্পী’। পুষ্করের মেলায় তাঁর নাচ চোখে পড়ে তৃপ্তি পাণ্ডে এবং হনুমন্ত সিংহের। তাঁরা দু’জনেই সে সময় রাজস্থান পর্যটন দফতরের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাঁদের ছায়ায় আরও অনেকটাই এগিয়ে যান গুলাবো।

১১ ২০

আটের দশকের গোড়ায় তিনি পা রাখেন জয়পুরে। লোকসংস্কৃতির অন্যতম পীঠস্থান এই শহরের সংস্কারমুক্ত পরিবেশে আরও বিকশিত হয় গুলাবোর প্রতিভা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরও তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে গুলাবোর নৃত্যশৈলি। কিছু দিন পর তিনিও রাজস্থানের পর্যটন বিভাগের অংশ হয়ে ওঠেন।

১২ ২০

গুলাবোর অদ্ভুত নৃত্যভঙ্গি দেখে তাজ্জব হয়ে যান দর্শকরা। তিনি জানান, কোনওদিন প্রথাগত নাচ শেখেননি। পোষ্য সাপের দলই তাঁর শিক্ষক। তাদের দেখেই শরীরকে দুমড়ে মুচড়ে ভাঙতে শিখেছেন। নাচের পোশাক নিজেই ডিজাইন করেন গুলাবো। উজ্জ্বল কালো ঘাগড়া চোলিতে কাচের টুকরো বসানো। এটাই তাঁর নাচের পোশাক।

১৩ ২০

ডফলি, মঞ্জীরা, ঢোলক এবং ছাং— এই বাদ্যযন্ত্রের যুগলবন্দিতে গুলাবোর সরীসৃপের মতো নাচ পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ। বহু সরকারি অনুষ্ঠানের পরে গুলাবো ১৯৮৫ সালে পারফর্ম করেন ওয়াশিংটনে। আজ দেশে বিদেশে তাঁর নৃত্যকলার অসংখ্য গুণগ্রাহী।

১৪ ২০

সে রকমই একজন গুণমুগ্ধ হলেন জ্যোতি তোম্মর। ২০১৯ সালে ‘পদ্মাবত’ ছবিতে ‘ঘুঙর’ নাচের কোরিয়োগ্রাফি করে জাতীয় পুরস্কার পান জ্যোতি। তিনি মনে করেন নাচ, চোখের দৃষ্টি এবং ঠোঁটের কোণে হাসি দিয়ে গুলাবো নিজেও দর্শকদের সম্মোহিত করেন সাপের মতোই।

১৫ ২০

একদিন যে জনগোষ্ঠী তাঁকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল, পরে তাঁরাই গর্বিত তাঁর সাফল্যে। সাপুড়ে পেশার অনেকের মেয়েই প্রশিক্ষণ নিয়েছে তাঁর কাছে। গুলাবোর নিজের নাচের স্কুলে বিভিন্ন রকমের রাজস্থানি লোকনাচ শেখানো হয়।

১৬ ২০

গুলাবোর স্বামী সোহননাথও একজন ধ্রপদী সঙ্গীতশিল্পী এবং হারমোনিয়ামবাদক। নিজের সাফল্যের পিছনে স্বামীর অবদানের কথাও ভুলতে পারেন না গুলাবো। জানিয়েছেন, প্রথম দিকে তাঁর এজেন্ট হয়ে স্বামী বিভিন্ন সংস্থায় ঘুরে ঘুরে অনু্ষ্ঠানের বরাত চাইতেন।

১৭ ২০

স্বামী সোহননাথের উৎসাহেই তিনি নিজের নৃত্যচর্চা চালিয়ে যেতে পেরেন, দাবি গুলাবোর। তাঁর সন্তানরাও প্রশিক্ষণ নিয়েছেন গুলাবোর কাছে। তাঁরাও ‘সপেরা নৃত্যকলা’-র চর্চা এগিয়ে নিয়ে যেতে চান।

১৮ ২০

দেশের বাইরে ডেনমার্কের কোপেনহেগেন এবং ফ্রান্সের প্যারিসেও ভারতীয় লোকনৃত্যের প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তিনি যুক্ত। ইতিমধ্যে সফর করেছেন শতাধিক দেশে। ২০১৬ সালে তিনি সম্মানিত হন ‘পদ্মশ্রী’ সম্মানে।

১৯ ২০

যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে ভালবাসেন গুলাবো। লকডাউনে অনলাইন ক্লাসের জন্য শিখেছেন ইন্টারনেট ব্যবহারের খুঁটিনাটি। তবে শুধু নাচই নয়। তাঁর উপার্জিত অর্থের একটা বড় অংশ ব্যবহার করা হয় সাপুড়ে গোষ্ঠীর ছেলেমেয়েদের শিক্ষাবাবদ।

২০ ২০

দেশবিদেশের বহু সম্মানে সম্মানিত গুলাবো কৃতজ্ঞ বাবা মায়ের কাছে। যাঁরা সমাজের চাপে মাথা নত করে তাঁকে অনাহুত অবাঞ্ছিত মনে করেননি। তাঁর কৃতজ্ঞতা রয়েছে পোষ্য সরীসৃপদের কাছেও। আপাত চোখে ঘৃণ্য এই সরীসৃপরাই তাঁকে শিখিয়েছে নাচের কৌশল। (ছবি: সোশ্যাল মিডিয়া)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
Follow us on:
আরও গ্যালারি
Advertisement