বিজেপির মুখ একটা। মুখোশও একটাই। — ছবি: পিটিআই।
শিক্ষা থেকে মূল্যবৃদ্ধি অনেক কিছু নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। কংগ্রেস এবং আম আদমি পার্টি সে সব প্রশ্ন তুলেও চলেছে। তবু গুজরাত বিজেপির বিশ্বাস, জিতিয়ে দেবেন মোদীজিই! তাই প্রচারে প্রচারে খালি নরেন্দ্রভাই মোদীর নাম। মাঝমধ্যে রাজ্যের প্রথম বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী কেশুভাই পটেলের নাম শোনা গেলেও আর কেউ নেই। এমনকি, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহও সে ভাবে নন।
এত মোদী-মোদী-মোদী শুনে একঘেয়ে লাগছে না? প্রশ্ন শুনে গুজরাত বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী দেবাংশী শাহ পাল্টা বরং প্রশ্ন করলেন, ‘‘কেন একঘেয়ে লাগবে? এটা তো মানতেই হবে যে, গুজরাতিদের অস্মিতা বাড়িয়ে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। রাজ্যে এমন মুখ্যমন্ত্রী আগে হয়নি। দেশে এমন প্রধানমন্ত্রীও আগে হয়নি। শুধু দেশে নয়, বিদেশেও তিনি সকলের মন জয় করেছেন।’’ গুজরাত বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে ‘শেঠ দামোদর দাস স্কুল অফ কমার্স’-এর রাস্তায় চা ছাড়াও নানা খাবারের দোকান। সেখানেই আড্ডা বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়াদের। রাজনীতির আলোচনা বিশেষ নেই। তবে মোদীর প্রসঙ্গ তুলতে কথা বললেন দেবাংশীরা। ওঁরই বন্ধু চেতন বরাইয়া বললেন, ‘‘আমরা কে কাকে ভোট দেব সেটা অন্য কথা। কিন্তু মোদী আমাদের কাছে অন্য কিছু। এখন আমরা কোথাও গেলে সকলে বলে মোদীর রাজ্যের লোক!’’
বিধানসভা ভোটে এটাই কাজে লাগাতে চাইছে গুজরাত বিজেপি। মোদী রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন ২০০১ সাল থেকে ২০১৪ পর্যন্ত। তিনি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর তাঁর ছেড়ে যাওয়া চেয়ারে বসেন আনন্দীবেন পটেল। দু’বছরের একটু বেশি সময় ছিলেন। ২০১৭ সালের ভোটের আগে আগে রাজকোট পশ্চিমের বিধায়ক বিজয় রূপাণি মুখ্যমন্ত্রী হন। আবার ২০২১ সালে বদল। বিজয়কে সরিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে বসেন ভূপেন্দ্র পটেল। আনন্দীবেন এখন উত্তরপ্রদেশের রাজ্যপাল। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বিজয় এ বার টিকিট পাননি। আনন্দীবেনের ছেড়ে যাওয়া ঘাটলোড়িয়া থেকে এ বারেও প্রার্থী হয়েছেন ভূপেন্দ্র। কিন্তু তিনিই কি ফের মুখ্যমন্ত্রী হবেন? দল তেমনটা মনে করলেও সবটা জানেন নরেন্দ্রভাই।
পদ্মের প্রচারে নতুন থিম— মোদীর সঙ্গে সেলফি। — নিজস্ব চিত্র।
শুধু আমদাবাদেই নয়, গুজরাতের অন্যত্রও ভোটপ্রচারে মুখ্যমন্ত্রী ভূপেন্দ্রর নাম নেই। বরং মোদীর মা হিরাবেনের নাম উঠছে প্রচারে। বলা হচ্ছে, ‘‘হিরাবেন এক হিরা দিয়েছেন গুজরাতকে, দেশকে। সেই হিরাই গুজরাতের গর্ব, দেশের গর্ব, আমাদের মুখ।’’ আসলে বিজেপিতে অন্য কোনও মুখই নেই! প্রার্থী যিনিই হোন না কেন, গুজরাত জুড়ে দলীয় দফতরের সামনে বা সমাবেশস্থলে শুধু মোদীর কাটআউট। তার সঙ্গে নিজস্বীও তোলার ব্যবস্থা রয়েছে। সে জন্য আগ্রহও কম নয়।
মোদীর পরে তিন-তিনজন মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন। কিন্তু তার পরেও বিজেপি যে রাজ্যে কোনও ‘মুখ’ তৈরি করতে পারেনি, সেটা বলা হচ্ছে কংগ্রেস বা আপের প্রচারে। কিন্তু তাদেরও তো তেমন কোনও ‘মুখ’ নেই! দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরীওয়ালের কথা বলছে আপ। তবে দলের ঘোষিত মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী রয়েছেন। ইসুদান গাদভি। বিজেপির অবশ্য দাবি, নিজেকে ‘কৃষকপুত্র’ বলে দাবি করা ইসুদানের নিজের জয়ই নিশ্চিত নয়। দ্বারকা জেলার খাম্বালিয়া আসনে কঠিন লড়াই তাঁর। ২০১২ সালে এখানে বিজেপি জিতলেও পর পর দু’বার জিতেছে কংগ্রেস। বর্তমান বিধায়ক বিক্রমভাই মাদামকেই ফের প্রার্থী করেছে ‘হাত’ শিবির।
নিজেও লড়াইয়ের মুখে আপের মুখ। — নিজস্ব চিত্র।
মুখ আড়ালে কংগ্রেসেরও। — নিজস্ব চিত্র।
প্রাক্তন সাংবাদিক ইসুদান বা তাঁর দল আপ অবশ্য এসব মানতে নারাজ। গুজরাত নির্বাচনের দায়িত্ব নিয়ে দিল্লি থেকে এসে আমদাবাদে ঘাঁটি-গাড়া আপ নেতা নীরজ পাণ্ডে বললেন, ‘‘অতীত দিয়ে তো বর্তমানের হিসাব চলে না। গত বার আপের ভোটপ্রাপ্তির হিসাব করলে তো এ বার আমরা লড়াইতেই নেই! কিন্তু স্বীকার না করলেও বিজেপি বা কংগ্রেস বুঝতে পারছে, লড়াই সহজ নয়। দিল্লি আর পঞ্জাবের সুশাসন গুজরাতও চাইছে।’’ কিন্তু মানুষের চাওয়া দিয়েই কি নির্বাচন জেতা যায়? সংগঠনও লাগবে তো! নীরজের দাবি, ‘‘গুজরাতে প্রায় ৫২ হাজার বুথ। তার প্রতিটিতেই এখন আপের ১০ থেকে ১৫ জন সদস্য রয়েছেন। রাজ্যের ৫০ লাখ মানুষের কাছে আমাদের ইস্তাহার পৌঁছে দেওয়া গিয়েছে।’’
মুখ্যমন্ত্রীর ‘মুখ’ নেই কংগ্রেসেরও। সনিয়া ও রাহুল গান্ধীর ছবি-সহ হোর্ডিং এক আধটা দেখা গেলেও প্রচারে শুধুই বিজেপির বিরোধিতা। সঙ্গে কংগ্রেস ক্ষমতায় এলে গুজরাতবাসীর জীবন সহজ করার প্রতিশ্রুতি। সে ভাবে আগ্রাসী প্রচার নেই। অথচ গত বিধানসভা নির্বাচনের ফলও দলের পক্ষে ইতিবাচক ছিল। ২০১২ সালে ৬১ আসনে জেতা কংগ্রেস আসন বাড়িয়ে ৭৭-এ পৌঁছেছিল ২০১৭ সালে। সেখানে বিজেপি ১১৫ থেকে নেমে এসেছিল ৯৯-এ। যদিও ১৮২ আসনের গুজরাতে ক্ষমতায় আসতে অসুবিধা হয়নি পদ্মের। পাঁচ বছর আগে শক্তিক্ষয়ের অভিজ্ঞতা নিয়েও এবারের লড়াইয়ে ‘নিশ্চিন্ত’ বিজেপি। ভাবটা এমন, নরেন্দ্রভাই সব করে দেবেন।!
গুজরাতে পরীক্ষিত পথেই হাঁটতে চাইছে বিজেপি। প্রচারে নিয়ে আসা হয়েছে ‘মর্নিং কনসাল্ট পলিটিক্যাল ইন্টেলিজেন্স গ্রুপ’ নামে এক সংস্থার সমীক্ষা। সেখানে বিশ্বের মধ্যে ‘সেরা রাষ্ট্রনায়ক’ হিসাবে মোদী ভোট পেয়েছেন ৭৭ শতাংশ। দ্বিতীয় অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী এবং তৃতীয় আমেরিকার প্রেসিডেন্ট। সেই রিপোর্ট দেখিয়ে আমদাবাদ বিজেপির যুবনেতা রীতেশ যোগী বললেন, ‘‘ভারতের গর্ব তো বটেই, এটা গুজরাতেরও অহঙ্কার! এই রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী গোটা বিশ্বে বন্দিত। তিনি ছাড়া আর দলের মুখ কে হবেন?’’
একই দাবি করলেন প্রসেনজিৎ সেনগুপ্ত। গুজরাত বিজেপির অন্য ভাষাভাষী শাখার সদস্য প্রসেনজিৎ আমদাবাদের বাঙালি ভোটারদের মধ্যে ভোটপ্রচারের দায়িত্বে। তাঁর কথায়, ‘‘শুধু গুজরাতের মূল বাসিন্দাদের মধ্যেই নয়, অন্য রাজ্য থেকে যাঁরা এখানে কাজের সূত্রে রয়েছেন, তাঁরাও মোদীকে নিয়ে গর্ব করেন। সেটা বলায় দোষ কোথায়! আর নতুন প্রজন্মের ভোটাররা মোদীকেই চেনেন। তাঁরা কংগ্রেসের সরকারই দেখেননি।’’ কিন্তু একেবারে নতুন ভোটাররাও তো মোদীকে দেখেননি? প্রসেনজিতের বক্তব্য, ‘‘দেখেননি মানে! সব সময় দেখছেন! শুধু নির্বাচনের সময় নয়, গুজরাতের যে কোনও প্রান্তের মানুষের সঙ্গে সারা বছর মোদী আছেন। বাইরে থেকে সবাই জাতপাতের ভাগ দেখেন। কিন্তু গুজরাত ও সব নিয়ে ভাবে না। এই রাজ্যের রাস্তা থেকে শিল্প— যে কোনও কিছু দেখলেই সকলে জানেন, সবটাই মোদীর পরিকল্পনা।’’
টানা ২৭ বছর ক্ষমতায় থাকার পরে প্রতিষ্ঠানবিরোধী হাওয়া থাকলেও আপাতদৃষ্টিতে তা ‘প্রবল’ বলে মনে হয় না। কিন্তু মোদীর পরে তিন জন মুখ্যমন্ত্রীকে বসিয়ে বা বড়সংখ্যক বিধায়ককে টিকিট না দিয়ে বিজেপি বুঝিয়ে দিয়েছে ‘চাপ’ আছে। সে সব নিয়ে ক্ষোভ-বিক্ষোভও আছে। দলের ভিতরেও পুরোপুরি স্বস্তি নেই। কিন্তু মোদী ঠিক উতরে দেবেন ভাব নিয়েই নিশ্চিন্তে গুজরাত বিজেপি। ভোটের প্রচার শুনলে বোঝা দায়, এটা বিধানসভা ভোট!