বিজেপি সরকারের ‘ঢালাও উন্নয়ন’-এর রথ জুহাপুরায় ঢোকেনি এখনও। —নিজস্ব চিত্র।
বাঙালি রেস্তরাঁ থেকে রোল আনানো হয়েছে ‘ভোটের অতিথি’র জন্য। গোটা অমদাবাদে ওই একটিমাত্র বাঙালি খাবারের দোকান। বাংলা থেকে গুজরাতে গিয়ে খাওয়া-দাওয়ায় না পোষালে সুপারমলের ওই রেস্তরাঁই একমাত্র ভরসা।
শহর জুড়ে আমিষ পদের হাহাকার রয়েছে এমনিতে। ‘হায়দরাবাদি বিরিয়ানি’ তৈরি হয় পালং শাক আর পনির দিয়ে। সে শহরে আচমকা আমিষ পদ এবং বাঙালির অতিপ্রিয় রোল পেয়ে যাওয়া, হাতে চাঁদ পাওয়ার সামিল। তবে গৃহকর্তা কথায় কথায় জানালেন, গোটা শহরে আমিষ বর্জনীয় হলেও একটা এলাকা এমনও রয়েছে, যেখানে আমিষেরই রমরমা, নানা ধরনের কাবাবের রাজধানী।
কোথায় সে এলাকা? গেলেই তো হয়। গৃহকর্তা ইতস্তত করলেন। তার পর বললেন, ‘‘ওটা জুহাপুরা, অমদাবাদের লোক ওই জায়গাটাকে মিনি পাকিস্তান বলে ডাকে।’’
আরও পড়ুন
গুজরাতেই সভাপতির প্রথম সাংবাদিক সম্মেলন, নিশানায় মোদী
লাখ চারেক মুসলিমের বাস জুহাপুরায়। সাবরমতীর পশ্চিম পাড়ে যে নিউ সিটি, সেই ঝাঁ-চকচকে অমদাবাদে অত বড় মুসলিম মহল্লা আর একটাও নেই। নেই বলেই ‘বিকাশ’-এর যাবতীয় পথ জুহাপুরার আশেপাশে গিয়েই শেষ হয়ে গিয়েছে। বিজেপি সরকারের ‘ঢালাও উন্নয়ন’-এর রথ জুহাপুরায় ঢোকেনি এখনও। নতুন অমদাবাদের অন্যান্য অংশের রাস্তাঘাট, নিকাশি, সৌন্দর্যায়নের সঙ্গে কোনও মিল নেই জুহাপুরার। যেন একলা, বেমানান দাঁড়িয়ে বিরাট সংখ্যালঘু মহল্লাটা।
আরও পড়ুন
সি-প্লেনে সবরমতী নদী পথে প্রচারে মোদী
টানটান উত্তেজনার একটা নির্বাচনের মুখে দাঁড়িয়ে কী ভাবছেন জুহাপুরার মানুষ? জানার জন্য ঢুঁ মারতেই হল জুহাপুরার গলিঘুঁজিতে। বাগ-এ-নিশাত পার্কের উল্টো দিকে হাতিম টাওয়ারে থাকেন মুজাহিদ। বাগ-এ-নিশাত নামেই পার্ক। আসলে ভেঙেচুরে, অযত্নে-অবহেলায় জরাজীর্ণ হয়ে থাকা একটা ঝোপঝাড়ে পরিণত হয়েছে সে। শহরের নানা এলাকায় চোখ জুড়িয়ে দেওয়া একের পর এক ‘বাগ’ রয়েছে। রক্ষণাবেক্ষণে বিন্দুমাত্র ত্রুটি খুঁজে বার করা ভার। কিন্তু জুহাপুরায় ঢুকেই সে ছবি বদলে যায়।
দেখুন ভিডিও
সংখ্যালঘু অধিকার আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত মুজাহিদ। আদর করেই ঘরে নিয়ে গেলেন। তার পর কথায় কথায় বললেন, ‘‘গুজরাতে এর আগে কোনও নির্বাচনে মুসলিমরা এতখানি অবজ্ঞার শিকার হননি। বিজেপি কোনও কালেই আমাদের কথা বলে না। কিন্তু কংগ্রেস বলত। এ বার কংগ্রেস ‘মুসলিম’ শব্দটা এক বারের জন্যও উচ্চারণ করছে না।’’
আরও পড়ুন
‘ব্লু হোয়েল-এ আটকে কংগ্রেস, ১৮ তারিখই তার শেষ পর্ব’
মুজাহিদের স্ত্রী আজিমাও মানবাধিকার কর্মী। উকিলও। তাঁর দেখা পাওয়া গেল বাটবায়। মূল শহরের বাইরে এ-ও এক সংখ্যালঘু মহল্লা। মুসলিম মহিলাদের কল্যাণে কর্মরত সংস্থা ‘হিম্মত’-এর অফিসে ছিলেন আজিমা। সঙ্গে আরও অনেকে। কেমন বুঝছেন এ বারের নির্বাচনের হালচাল? আজিমা আরও স্পষ্টবাদী। বললেন, ‘‘কংগ্রেস ভাবছে, মুসলিমদের উন্নয়নের কথা বললেই ভোটের বাজারে মেরুকরণ হয়ে যাবে। তাই নির্বাচনী প্রচারে আমাদের কথা কংগ্রেস বলছে না। তবু ভরসা রাখছি। ধরে নিচ্ছি এটা কংগ্রেসের নির্বাচনী কৌশল। বিজেপি-কে ভোট দেওয়া তো সম্ভব নয়। তাই এ বারও কংগ্রেসকেই ভোটটা দেব। কিন্তু পরবর্তী কালেও যদি দেখি এই রকমই অবজ্ঞা চলছে বা কংগ্রেস তার ধর্মনিরপেক্ষ ভাবমূর্তি বদলে ফেলেছে, তা হলে আমাদেরও অন্য রকম ভাবতে হবে। ২০১৯-এর নির্বাচনও তো সামনেই।’’
শুধু মুজাহিদ বা আজিমা নন, শুধু জুহাপুরা বা বাটবা নয়, দরিয়াপুর, জামালপুর, দানে লিমড়া, সরখেজ রোজা, নারোডা পাটিয়া— অমদাবাদের সব সংখ্যালঘু মহল্লাতেই এই তীব্র অভিমান ঘুরপাক খাচ্ছে এখন। বিজেপি-র কাছ থেকে উন্নয়ন বা ইতিবাচক কিছু আশাই করে না গুজরাতের সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী। কিন্তু যে দলের উপর দশকের পর দশক ধরে ভরসা রেখে আসছেন মুসলিমরা, সেই কংগ্রেস সভাপতি একবারও মুসলিমদের কথা বললেন না! শুধু মন্দিরে মন্দিরে ঘুরেই প্রচার সেরে ফেললেন! বেশ বিস্মিত মুসলিম মহল্লা।
শুধু অভিমান আর বিস্ময়ে অবশ্য সীমাবদ্ধ থাকছে না মুসলিমদের প্রতিক্রিয়া। সরাসরি হুঁশিয়ারির সুরও কিন্তু বেরিয়ে আসছে। আজিমা সাফ বললেন, ‘‘রাজ্যের জনসংখ্যার ১০ শতাংশ আমরা। আমাদের অবজ্ঞা করেও তুমি এগিয়ে যাবে, এমনটা হতে পারে না।’’ কিন্তু করবেনই বা কী? কংগ্রেস ছাড়া বিকল্প তো নেই। এ বার আরও সোজাসাপটা জবাব আজিমার, ‘‘বিকল্প তৈরি করে নেব।’’
আজিমার এই মন্তব্য যে কথার কথা নয়, তা কিন্তু গুজরাতের রাজনৈতিক শিবিরও মেনে নিচ্ছে। প্রকাশ্যে মুখ খুলতে নারাজ নেতারা। কিন্তু নির্বাচনী প্রচারে সংখ্যালঘু প্রসঙ্গ পুরোপুরি এড়িয়ে যাওয়ার যে কৌশল এ বার কংগ্রেস নিয়েছে, তাতে আলাদা সংখ্যালঘু মঞ্চ গজিয়ে ওঠার সম্ভাবনাও যে দেখা দিয়েছে, সে কথা নেতারা ঘনিষ্ঠ বৃত্তে স্বীকার করে নিচ্ছেন। তেমন কিছু হলে, আরও কট্টর মেরুকরণের পথে এগবে গুজরাতি সমাজ। আশঙ্কা বিশ্লেষকদের।