National News

দেশের ভিতরেই ‘বর্ডার’! এক দিকে হিন্দু, অন্য দিকে মুসলমান

দোষটা ওদের নয়। তাকিয়ে দেখুন, ময়লা আর আবর্জনার স্তূপে ভরে আছে গলি, তস্য গলি— মহল্লার চারপাশ। নিকাশির নামমাত্র একটা ব্যবস্থা সদ্য, মাস দু’য়েক হল হয়েছে। হ্যাঁ, নামমাত্রই। কারণ, সেই ব্যবস্থায় আর যা-ই হোক বর্জ্যের নিকাশ যে হয় না, সেটা নিশ্চয়ই ঘোর মালুম হচ্ছে আপনার!

Advertisement

অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়

অমদাবাদ শেষ আপডেট: ১৪ ডিসেম্বর ২০১৭ ১৩:৪৪
Share:

সঙ্ঘবদ্ধ, একজোট এবং উন্নয়নের যাবতীয় স্রোত থেকে কয়েক সহস্র ক্রোশ দূরে। ছবি: সংগৃহীত।

ভোটের সকাল। আপনি হাঁটছেন রাস্তা দিয়ে। তবে, সাবধানে হাঁটুন। এখানে রাস্তা নেই। শুধু খানা আর খন্দ!

Advertisement

নাকে হাত চাপা দিন। দুর্গন্ধে টিকতে পারবেন না! মশা-মাছি ভনভনিয়ে উড়ছে, আপনার গা ঘেঁষেই। গায়েও এসে বসছে!

দোষটা ওদের নয়। তাকিয়ে দেখুন, ময়লা আর আবর্জনার স্তূপে ভরে আছে গলি, তস্য গলি— মহল্লার চারপাশ। নিকাশির নামমাত্র একটা ব্যবস্থা সদ্য, মাস দু’য়েক হল হয়েছে। হ্যাঁ, নামমাত্রই। কারণ, সেই ব্যবস্থায় আর যা-ই হোক বর্জ্যের নিকাশ যে হয় না, সেটা নিশ্চয়ই ঘোর মালুম হচ্ছে আপনার!

Advertisement

জল চেয়ে বসবেন না কোনও বাড়িতে। এখানে জলের বড় আকাল। মাত্র মাস ছয়-সাত হল জলের লাইন এসেছে এ পাড়ায়। ব্যবস্থায় তাই গলদ আছে।

আপনি এসে পড়েছেন ঝাঁ-চকচকে অমদাবাদ শহরের জুহাপুরা ঘেটোর আল আতিক পার্ক সোসাইটিতে। ঘেটো, কেন না গত অনেকগুলো বছর ধরে মুসলিমরা এ ভাবেই বাঁচছেন গুজরাত জুড়ে! সঙ্ঘবদ্ধ, একজোট এবং উন্নয়নের যাবতীয় স্রোত থেকে কয়েক সহস্র ক্রোশ দূরে।

আরও পড়ুন
‘আমাদের জন্য নয়, ভোটের কারণেই ওরা তালাক-বিরোধী’

আল আতিক পার্ক সোসাইটির যে কোনও একটা উঁচু বাড়ির ছাদে উঠে পড়ুন। ২০ ফুটের দেওয়াল এবং তার উপরে দু’ফুটের কাঁটা তারের ‘বেড়া’ পেরিয়ে চোখ রাখুন— ওটা বকেরি সিটি। দেখুন, সেখানকার ছন্দটা স্বাভাবিক আর পাঁচটা শহুরে মহল্লার মতো। আপনার কল্পনায় যতটা ছন্দ আসতে পারে, ঠিক ততটাই। বেড়ার ও-পারে ওটা হিন্দু মহল্লা। দুটোই বিজেপি নেতৃত্বাধীন অমদাবাদ কর্পোরেশনের অধীনে। এই দুই মহল্লার বিপরীত দুই ছবি আপনাকে চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দেবে, গুজরাতের প্রায় সাড়ে ৯ শতাংশ মুসলমান এখন কেমন ভাবে বেঁচে আছেন! এই বিরাট নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় যাঁদের ঘিরে কোনও রাজনৈতিক ঔৎসুক্য নেই। একই রকম ভাবে, যাঁদের একটা বড় অংশের মধ্যেও উৎসাহ নেই এই নির্বাচন ব্যাপারটা নিয়ে।

‘বর্ডার’ পেরিয়ে। দেখুন ভিডিও

আল আতিক পার্ক আর বকেরি সিটি নয়— তফাতটা আপনার চোখে পড়বে সর্বত্রই। মুসলিম মহল্লা জুহাপুরার পর ‘বর্ডার’ পেরিয়ে (এখানে একে ‘বর্ডার’ই বলেন স্থানীয়েরা) পা রাখুন হিন্দু মহল্লা ভেজলপুরায়। তফাত দেখে নিন একই ভাবে। প্রদীপ এবং অন্ধকারের অনাকাঙ্ক্ষিত সহাবস্থান।

আরও পড়ুন
ভোটের এই গুজরাতে আর যাই থাক, ‘গুজরাত মডেল’ নেই

এমনটা আগে ছিল না। জুহাপুরার শেখ জালালুদ্দিন, ফকরুদ্দিন অথবা আব্দুল খালেকরা গল্প করছিলেন— আজ থেকে বছর তিরিশ-চল্লিশ আগেও কেমন ভাবে এই শহরে একসঙ্গে মিশে থাকতেন হিন্দু-মুসলমান। ইদে আর নবরাত্রিতে মিলেমিশে যেত সব কিছু। আশির দশকের শেষ দিক থেকেই মেরুকরণের রাজনীতি শুরু হল। উত্তেজনার আগুনে সেঁক নিতে থাকল রাজনৈতিক ব্যবস্থা। আগ্রাসী হতে থাকল বিজেপি। এবং অবশেষে ১৯৯২-তে বাবরি মসজিদ ধ্বংস। দুই সম্প্রদায় আস্তে আস্তে আলাদা হয়েই যাচ্ছিল। তার পরে ২০০২-এর দাঙ্গা কফিনে শেষ পেরেকটা বসিয়ে দিয়ে গেল।

পেট বোঝে না ধর্মের ভাষা। দেখুন ভিডিও

অমদাবাদ শহরে হিন্দু এবং মুসলিমরা আর এক জায়গায় থাকতে পারেন না। থাকেন আলাদা আলাদা, ঘেটো করে। জুহাপুরা সাড়ে চার লাখ মানুষের এমনই এক ঘেটো। ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সকলেই এখানে থাকেন। শর্ত একটাই, মুসলিম হতে হবে। হিন্দু মহল্লায় যাঁদের কোনও জায়গা নেই!

ক্রমাগত কোণঠাসা হতে থাকা এই মুসলিমদের সম্পর্কে নির্বাচনী-আগ্রহ কতটা, তা প্রার্থী তালিকায় চোখ রাখলেই মালুম হয়ে যায়। ২০০২, ২০০৭, ২০১২ এবং ২০১৭— এই চারটি বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি-র মুসলিম প্রার্থীর সংখ্যা শূন্য। কংগ্রেস গত নির্বাচনে ৭ জন মুসলমান প্রার্থীকে দাঁড় করিয়েছিল। এ বার সেই সংখ্যাটা কমে ৬-এ দাঁড়িয়েছে। বিজেপি-র প্রতি নিদারুণ ঘৃণা মুসলিম সমাজকে কংগ্রেসের দিকে ঠেলে রাখে ঠিকই, কিন্তু একই সঙ্গে তীব্র ক্ষোভ এবং অভিমানও জন্ম নেয়। যখন তাঁরা রাহুল গাঁধী বা কংগ্রেসের অন্য নেতাদের মুখে মুসলিমদের দুর্দশার কোনও কথা গোটা নির্বাচনী প্রচার-পর্বে শুনতে পান না, তখন। সংখ্যালঘুদের অধিকার নিয়ে কাজ করছেন নব্য যুবা মুজাহিদ নাফিস। তিনি বলছিলেন, ‘‘জানেন, মুসলমানদের অবস্থা এমনই দাঁড়িয়েছে যে, আমাদের অধিকারটা ঠিক কী, সেটা গুলিয়ে গিয়েছিল। আমাদেরও যে কিছু ন্যায্য দাবি আছে এবং সেটা নিয়ে আওয়াজ তোলা যায়, সেটাই আমরা ভুলে যাচ্ছিলাম।’’

এই সেই ২০ ফুটের দেওয়াল এবং তার উপরে দু’ফুটের কাঁটা তারের ‘বেড়া’।—নিজস্ব চিত্র।

কারণ, এই সম্প্রদায়ের কাছে এত দিন বেঁচেবর্তে থাকাটাই প্রধান হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বিশেষ করে ২০০২-এর সেই দাঙ্গার পর থেকে। অধিকার, সমানাধিকার, দাবি— এ সব তো অনেক পরের কথা। আগে তো বেঁচে থাকা! এবং সেটা একসঙ্গেই। আর সে জন্যই ঘেটো। সেখানে ধনী আছেন, গরিব আছেন, বিশাল বাড়ি আছে, আছে ঝুপড়িও। কিন্তু, সকলে একসঙ্গে আছেন। এবং আশঙ্কায় আছেন।

আরও পড়ুন
এক বেপরোয়া যুবককে ঘিরে তারুণ্যের উচ্ছ্বাস, প্রতিপক্ষ খোদ মোদী

ভোটের লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলো বলছিলেন, ‘‘দেখুন আসল ভয়টা কী হয় জানেন, উন্নয়নের ভাগটা সব জায়গায় এসে পৌঁছচ্ছে না। গ্রামে গিয়ে দেখুন, প্রতি দিন কতটা ক্ষোভ জন্মাচ্ছে!’’ ওই লাইনেই দেখা হল মহম্মদ আলির সঙ্গে। এ বারই প্রথম ভোট দিচ্ছেন ওই তরুণ। তাঁর মুখেও ক্ষোভের ভাষা। বলছিলেন, ‘‘আমাদের দর্জির ব্যবসা। গত সাত বছর ধরে লাভের কোনও মুখ দেখিনি। আগে তো খেতে হবে। পেট তো আর ধর্ম বোঝে না!’’ আসলে উন্নয়নের মোহভঙ্গ যত বেশি হবে, বিজেপি তত বেশি আস্তিন থেকে হিন্দুত্বের তাস বার করবে। আলিদের ভয়টা সেখানেই। তাঁর কথায়, ‘‘জানেন, বড্ড ভয়ে থাকি। আমি মুসলমান, এই বোধে বাঁচতে চাই না। আমি ভারতবাসী, এই ভাবনায় বাঁচি। বাঁচতে চাই। আর একটাই প্রার্থনা, রোজ দু’বেলা দু’মুঠো যেন খেতে পাই। ভাল ভাবে যেন বেঁচে থাকি। মাথার উপর যেন ছাদ থাকে।’’

এই প্রার্থনা নরেন্দ্র মোদীরা কি শুনতে পান? অমদাবাদের জুহাপুরা কিন্তু সে কথা বলছে না!

গুজরাত নির্বাচন নিয়ে সব খবর পড়তে এখানে ক্লিক করুন।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement