কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়নমন্ত্রী গিরিরাজ সিংহ। ছবি: পিটিআই।
রাজ্যের বকেয়া টাকা পাওয়ার জন্য মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে বৈঠকে বসার কোনও পরামর্শ তিনি দেননি বলে আজ দাবি করলেন কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়নমন্ত্রী গিরিরাজ সিংহ। গতকাল তৃণমূলের লোকসভার দলনেতা সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় দাবি করেছিলেন, তাঁকে ওই পরামর্শ দিয়েছিলেন গিরিরাজ। আজ গিরিরাজ সেই কথোপকথন অস্বীকার করলে সুদীপ বলেন, ‘‘হতে পারে, তিনি চাননি তাঁর ওই পরামর্শ প্রকাশ্যে চলে আসুক।’’
এ বারের শীতকালীন অধিবেশনের প্রথম দিন থেকেই পশ্চিমবঙ্গের প্রতি কেন্দ্রীয় বঞ্চনার অভিযোগকে সংসদে তুলে ধরার কৌশল নিয়েছেন তৃণমূল নেতৃত্ব। সেই মতো গতকাল লোকসভায় এ প্রসঙ্গে সরব হয় তৃণমূল, কক্ষত্যাগও করে কিছু ক্ষণের জন্য। পরে লোকসভার বাইরে সুদীপের দাবি, বেলা ১২টা নাগাদ গিরিরাজ পাশে এসে বসে তাঁকে বলেন, তাঁর (মন্ত্রীর) সঙ্গে বৈঠকের পরিবর্তে মমতা দিল্লি এলে যেন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে বাংলার বকেয়া অর্থের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন।
সংবাদমাধ্যমে বিষয়টি সামনে আসতেই সুদীপের মাধ্যমে মমতাকে বার্তা পাঠানোর বিষয়টি অস্বীকার করেন গিরিরাজ। আজ সংসদ চত্বরে দাঁড়িয়ে তিনি বলেন, ‘‘এ ধরনের কোনও বক্তব্যের বিষয়ে আমার জানা নেই। সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় ভুল কথা বলছেন।’’ পরে এ প্রসঙ্গে সুদীপ বলেন, ‘‘ওই আলোচনা সম্ভবত গোপন রাখতে চেয়েছিলেন গিরিরাজ। অথবা বিষয়টি জানাজানি হওয়ায় কলকাতা থেকে কোনও ফোন আসায় অবস্থান পরিবর্তন করেছেন গিরিরাজ। কিন্তু বিষয়টি যে হেতু জনস্বার্থের সঙ্গে জড়িত এবং মুখ্যমন্ত্রী-প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে বৈঠক একটি প্রশাসনিক বিষয়, তাই এ নিয়ে গিরিরাজ মুখ খুললেও সমস্যা হত না।’’
আজ উত্তরবঙ্গে যাওয়ার পথে বিমানবন্দরে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক প্রসঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘অতীতে বাংলাকে বঞ্চনার প্রতিবাদ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তিন বার দেখা করেছি। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীকে চিঠিও লেখা হয়েছে। আমরা দিল্লি চলো অভিযানও করেছি এবং দিল্লি পুলিশের কাছে ধর্নার জন্য অনুমতিও চেয়েছিলাম। আমরা এখনও অনুমতির অপেক্ষায় রয়েছি। আবার দিল্লি গেলে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার জন্য সময় চাইব।’’
একশো দিনের কাজের প্রকল্পে টাকা আটকে রাখা নিয়ে আজ রাজ্যসভাতেও দফায় দফায় তৃণমূলের সাংসদেরা সরব হন। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো, কেন্দ্র-রাজ্য সহযোগিতা নিয়ে আলোচনার দাবি তোলেন।
রাজ্যসভায় দেশের আর্থিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার সময় তৃণমূল সাংসদ শান্তনু সেন অভিযোগ তোলেন, রাজনৈতিক ভাবে হারাতে না পেরে কেন্দ্রীয় সরকার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারকে আর্থিক ভাবে বিপাকে ফেলতে চাইছে। একশো দিনের প্রকল্পে ২১ লক্ষ মানুষ কাজ করে বসে রয়েছেন। দু’বছর হয়ে গেলেও বকেয়া মজুরি পাচ্ছেন না। একের পর এক কেন্দ্রীয় দল পাঠানো হয়েছে। রাজ্য প্রশাসন কেন্দ্রেরসমস্ত প্রশ্নের জবাব দিয়েছে। কেন্দ্রের নির্দেশ মতো কী কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তা জানিয়েছে। তার পরেও টাকা আটকে রাখা হয়েছে। জাতীয় গ্রামীণ স্বাস্থ্য মিশনের টাকাও আটকে রেখেছে কেন্দ্র।
শান্তনু বলেন, মঙ্গলবারই কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রক সংসদে জানিয়েছে, পশ্চিমবঙ্গের থেকে উত্তরপ্রদেশেবেশি সংখ্যক ভুয়ো জব কার্ড বাতিল করা হয়েছে। বিজেপির দুই ঘনিষ্ঠ দল, বিজু জনতা দল ও ওয়াইএসআর কংগ্রেস শাসিত ওড়িশা, অন্ধ্রপ্রদেশে ভুয়ো জব কার্ডের সংখ্যা অনেক বেশি। কিন্তু সেখানে কোনও কেন্দ্রীয় দল যায়নি। পশ্চিমবঙ্গ একশো দিনের কাজের জব কার্ডের সঙ্গে আধার সংযুক্তিকরণের হারে গোটা দেশে দ্বিতীয়। ৯৯.৬৮ শতাংশ জব কার্ড আধারের সঙ্গে সংযুক্ত। তার পরেও গরিব মানুষের টাকা আটকে রাখা হয়েছে। তৃণমূলের সাংসদ জহর সরকার বলেন, ‘‘রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলি কর্পোরেট সংস্থার কোটি কোটি টাকার ঋণ মকুব করে দিচ্ছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে গরিব মানুষের একশো দিনের কাজের প্রকল্পের টাকাআটকে রেখেছে।’’
একশো দিনের কাজের টাকা আটকে রাখা নিয়ে আজ রাজ্যসভায় জহর সরকারের প্রশ্নের লিখিত উত্তরে কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রী গিরিরাজ সিংহ জানান, কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশ না মানায় রোজগারনিশ্চয়তা আইন অনুযায়ীই ২০২২-এর ৯ মার্চ থেকে টাকা আটকে রাখা হয়েছে। আইন অনুযায়ী প্রকল্পকে দুর্নীতিমুক্ত ও দায়বদ্ধ রাখার দায় রাজ্য সরকারের। কেন্দ্র রাজ্যকে এই প্রকল্পের কাজ ভাল ভাবে করার পরামর্শ দিয়েছে। কিন্তু বারবার বলা সত্ত্বেও বিভিন্ন মাপকাঠিতে এখনও চোখে পড়ার মতো কিছু ধরা পড়েনি। প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনাতেও কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তার সন্তোষজনক উত্তর মেলেনি। গিরিরাজ জানিয়েছেন, একশো দিনের কাজে রাজ্যের ৫৫৫৩ কোটি টাকা ও প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনায় ৮৪১২ কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে।
জবাবে জহর বলেন, “কেন্দ্রের উত্তরে এ কথা বলা নেই যে, পশ্চিমবঙ্গে ৯৯ শতাংশের বেশি জব কার্ডযাচাই করা হয়েছে। যেখানে উত্তরপ্রদেশের মাত্র ৮২ শতাংশের মতো জব কার্ড যাচাই করা হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে ৪৮টি কেন্দ্রীয় দল গিয়েছে। কেন্দ্রের ১৪টি চিঠির জবাব দেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রের কাছে রাজ্যের মোট ১৫,৯৮৭ কোটি টাকা বকেয়া পাওনা রয়েছে।’’ তৃণমূলের আর এক সাংসদ আবীর রঞ্জন বিশ্বাস রাজ্যসভায় বলেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নিজে একটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। কিন্তু কেন্দ্রে তাঁর সরকার জমিদারের মতো আচরণ করছে।’’ বিজেপি সাংসদেরাও পাল্টা সুর চড়ান। উত্তরপ্রদেশের বিজেপি নেতা দীনেশ শর্মা বলেন, ‘‘আগে পশ্চিমবঙ্গেই মানুষ কাজ খুঁজতে যেত। এখন বাংলার মানুষকে রাজ্যের বাইরে যেতে হচ্ছে। কিন্তু উত্তরপ্রদেশে করোনার সময়ে পরিযায়ী শ্রমিকেরা ফিরে এলে তাঁদের স্বরোজগারের বন্দোবস্তকরা হয়েছে।’’
এ প্রসঙ্গে মমতাকে খোঁচা দিয়েছেন শুভেন্দু অধিকারীও।এ দিন ডেবরায় তাঁর বক্তব্য, ‘‘প্রধানমন্ত্রীর কাছে মুখ্যমন্ত্রী যখন সময় চান, উনি সময় দেন। অথচ মুখ্যমন্ত্রী আমাদের বিরোধী দলের নেতা, সাংসদ, বিধায়কদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন না।’’ ভুয়ো জব কার্ডে উত্তরপ্রদেশ যে এগিয়ে, সে প্রসঙ্গে তাঁর মন্তব্য, ‘‘উনি (মুখ্যমন্ত্রী) আগে জবাব দিন, পশ্চিমবঙ্গে লক্ষ লক্ষ ভুয়ো জব কার্ড কাজ করে টাকা তুলে নিয়ে গিয়েছে, সেই ভূত কারা? তাঁর রাজ্যের বিষয় যোগী আদিত্যনাথবুঝে নেবেন।”