গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
লোকসভায় দেশের মধ্যে সব থেকে বেশি সাংসদ পাঠায় এই রাজ্যই। দেশের রাজনীতিতে তাই বরাবরের চালু কথা— উত্তরপ্রদেশ যার, দেশ তার। এমনও বলা হয় উত্তরপ্রদেশের দখল নিতে পারলেই মসৃণ হয় প্রধানমন্ত্রিত্বের পথ। ভারতীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসে সব থেকে বেশি সংখ্যক প্রধানমন্ত্রী উপহার দিয়েছে এই রাজ্যই। নেহরু থেকে চন্দ্রশেখর, ইন্দিরা থেকে রাজীব— সংখ্যাটা নেহাত কম নয়।
২০১৪ লোকসভাতেও উত্তরপ্রদেশ দু’হাত ভরে আশীর্বাদ করেছিল মোদী-শাহ জুটিকে। উত্তরপ্রদেশের দায়িত্ব হাতে নিয়ে এই রাজ্যে যে গেরুয়া ঝড় তুলেছিলেন অমিত শাহ, তাতেই সহজ হয়ে গিয়েছিল মোদীর প্রধানমন্ত্রী হওয়ার লড়াইটা। ৮০টি আসনের লড়াইতে রাজ্যকে কার্যত বিরোধীশূন্য করে ৭৩টি আসন তুলে নিয়েছিলেন তাঁরা।
২০১৯-এও তাই বিশেষ নজর ছিল উত্তরপ্রদেশের দিকেই। শাসক এনডিএ হোক বা কংগ্রেস বা মায়া-মুলায়ম, উত্তরপ্রদেশের দখল নিতে তৎপরতা দেখিয়েছিল সব পক্ষই। কেন্দ্রে ও রাজ্যে ক্ষমতায় থাকা সত্ত্বেও রামমন্দির তৈরি করতে না পারা, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, গোরক্ষকদের তাণ্ডব, লভ জিহাদ, কোনও ইস্যুই হাতছাড়া করতে চায়নি বিরোধীরা। অন্য দিকে নজর ছিল জাতপাতের সমীকরণ দিয়ে ভোটের বাক্সের হিসাব উল্টে দেওয়া।
সেই লক্ষ্যেই কাজটা করেছিলেন অখিলেশ যাদব। উত্তরপ্রদেশের দুই প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী মায়াবতী আর মুলায়মের চির শত্রুতার প্রাচীর ভেঙে সমাজবাদী পার্টি আর বহুজন সমাজ পার্টিকে এক জায়গায় এনেছিলেন তিনি। নিজের বাবা মুলায়মকে কৌশলে সরিয়ে দলের মধ্যে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার পাশাপাশি হাত মিলিয়েছিলেন মায়াবতীর সঙ্গে। তৈরি হয়েছিল পিসি-ভাইপো মহাজোট, যাকে বলা হচ্ছিল ‘বুয়া-বাবুয়া গটবন্ধন’, যেখানে সামিল হয়েছিল অজিত সিংহের রাষ্ট্রীয় লোক দলও। মহাজোটের লক্ষ্যই ছিল যাদব-দলিত-মুসলিম-জাঠ ভোটব্যাঙ্ককে এককাট্টা করা।
অন্য দিকে থেমে ছিল না কংগ্রেসও। মহাজোটে না নেওয়ায় ‘একলা চল’ নীতিতেই উত্তরপ্রদেশের রাস্তায় নেমেছিল তারা। যদিও কোথাও প্রার্থী না দিয়ে, কোথাও শেষ মুহূর্তে প্রার্থী প্রত্যাহার করে মহাজোটের সুবিধা করে দিতে চেয়েচিল তারা। প্রচার পর্বের বিভিন্ন সময়ে রাহুল নিজেও সে কথা বলেছেন। একই সঙ্গে শেষ মুহূর্তে তারা চমক দিয়েছিল প্রিয়ঙ্কা সরাসরি রাজনীতির ময়দানে নামিয়ে। কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক করার পাশাপাশি তাঁকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল পূর্ব উত্তরপ্রদেশের, যাকে গেরুয়া দুর্গ বললেও কম বলা হয়। মনে রাখতে হবে পূর্ব উত্তরপ্রদেশের মধ্যেই পড়ে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের গোরক্ষপুর বা খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বারাণসী।
পরিস্থিতি যে খুব সহজ ছিল, তা নয়। এই রকম একটা জায়গা থেকেই আগাগোড়া হিন্দুত্বের লাইনে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল গেরুয়া ব্রিগেড। সারা দেশে যখন গোরক্ষকদের বাড়াবাড়ি নিয়ে সমাজের একটা অংশে প্রতিবাদের ঝড় উঠছে, তখন তারা পাশে দাঁড়িয়েছিল গোরক্ষকদেরই। পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকার পরও অযোধ্যার বিতর্কিত জমিতে রামমন্দির তৈরির দাবিতে অটল ছিল তারা, যা ফের জায়গা করে নিয়েছিল তাদের নির্বাচনী ইস্তাহারেও।
এই হিন্দুত্বের লাইনই ফের দু’হাত তুলে আশীর্বাদ করল বিজেপিকে। সে ভাবে কাজ করল না জাতপাতের সমীকরণ। অঙ্কের হিসেবে মহাজোট এগিয়ে থাকলেও তা প্রভাব ফেলল না ভোটবাক্সে। উত্তরপ্রদেশে ফের ছুটল বিজেপির অশ্বমেধের ঘোড়া। যে ঝড়ের দাপটে কংগ্রেস তো বটেই, বেসামাল হয়ে পড়ল মায়া-অখিলেশের মহাজোটও। অমেঠীও হাতছাড়া হয়েছে কংগ্রেসের। সেখানে খোদ রাহুল গাঁধী হেরে গিয়েছেন স্মৃতি ইরানির কাছে। সব মিলিয়ে পাঁচ বছর পর আরও চওড়া হল মোদী-শাহ জুটির হাসি। মোদীর প্রধানমন্ত্রিত্বের রাস্তা থেকে সব কাঁটা সরিয়ে যেন আবার ফুল ছড়িয়ে দিল উত্তরপ্রদেশ।