ভয়াবহ। ফাইল চিত্র।
কার্বন নিঃসরণ কমানোর ঘোষিত লক্ষ্যমাত্রা থেকে পৃথিবীর বেশির ভাগ দেশই এখনও অনেক দূরে। ইউক্রেন যুদ্ধের জেরে বিশ্ব জুড়েই জীবাশ্ম জ্বালানির উপরে নির্ভরতা কমার বদলে বেড়ে গিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে উষ্ণায়ন এবং স্বাস্থ্যের উপরে তার প্রভাব বিষয়ে ল্যানসেট-এর নতুন রিপোর্ট (‘ল্যানসেট কাউন্টডাউন অন হেলথ অ্যান্ড ক্লাইমেট চেঞ্জ’) যে ছবি দেখাচ্ছে, তা রীতিমতো ভয়াবহ।
এই রিপোর্টের বহু পরিসংখ্যান ইউক্রেন যুদ্ধের আগেকার। তাতেই দেখা যাচ্ছে, ২০২০ সালে ভারতে ৩ লক্ষ ৩০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে এমন দূষণের প্রকোপে, যা সরাসরি জীবাশ্ম জ্বালানির সঙ্গে যুক্ত। অর্থাৎ প্রতি ২ মিনিটে ১.২ জন মানুষ ভারতে মারা যাচ্ছেন, যার জন্য দায়ী জীবাশ্ম জ্বালানি। জীবাশ্ম জ্বালানি বা ফসিল ফুয়েল বলতে বোঝায় কয়লা, তেল, গ্যাস ইত্যাদি জ্বালানিকে, যা তৈরি হয় উদ্ভিজ্জ বা প্রাণিজ জীবাশ্ম থেকে। ল্যানসেটের রিপোর্ট সব দেশকেই সাবধান করে বলেছে, যে ভাবে সকলে জীবাশ্ম জ্বালানিকে অগ্রাধিকার দিয়ে ভর্তুকি বাড়িয়ে চলেছে, তাতে একাধারে খাদ্য সঙ্কট, রোগ সংক্রমণ, তাপজনিত রোগের প্রকোপ, শক্তি সঞ্চয়ে ধস এবং দূষণে মৃত্যুর ঝুঁকি উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০১০ সালের তুলনায় কার্বন নিঃসরণের মাত্রাও কমার বদলে এখনই ১৪ শতাংশ বেড়ে রয়েছে। অথচ প্যারিস চুক্তি অনুযায়ী ওই নিঃসরণের মাত্রা ২০৩০-এর মধ্যে ২০১০-এর তুলনায় ৪৩ শতাংশ কমানোর কথা।
রিপোর্টে বলা হয়েছে, শিল্প বিপ্লব-পূর্ব বিশ্বের চেয়ে এখনকার পৃথিবী ১.১ ডিগ্রি সেলসিয়াস উষ্ণতর। তাতেই তাপপ্রবাহ, সাইক্লোন, বন্যায় জেরবার গোটা বিশ্ব। তার পরেও দেশগুলি জীবাশ্ম জ্বালানিতে রাশ না টেনে যে পথে হেঁটে চলেছে, তাতে এই শতকের শেষে ওই ১.১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে দাঁড়াবে ২.৭ সেলসিয়াসে! অথচ অতিমারির পরে আর্থিক পুনরুজ্জীবনের খাতে পৃথিবী জুড়ে যত অর্থ বরাদ্দ হয়েছে, তার খুব সামান্য অংশই বায়ু দূষণ কমানোর খাতে গিয়েছে। রিপোর্টে আশঙ্কা, অর্থনীতির চাকা ঘোরানোর তাগিদে এর নিট ফল হয়তো দূষণের মাত্রা বাড়িয়েই তুলবে।
শুধু ভারতেই জ্বালানি দূষণে ২০২০ সালে ৩ লক্ষ ৩০ হাজার মানুষ মারা গিয়েছেন। অর্থাৎ হিসেব করলে প্রতি দু’মিনিটে একাধিক প্রাণ গিয়েছে। ওই বছরেই একই কারণে চিনে মারা গিয়েছেন ৩ লক্ষ ৮০ হাজার জন। ইউরোপে ১ লক্ষ ১৭ হাজার জন। আমেরিকায় দূষণজনিত রোগে মৃত্যুর সংখ্যা ৩২ হাজার, তার এক তৃতীয়াংশ জ্বালানি দূষণে। অথচ ২০১৯ সালে ৬৯টি দেশ ৪০০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি অর্থ খরচ করেছে জীবাশ্ম জ্বালানির ভর্তুকিতে। এই খাতে ভারতের খরচ ৩৪ বিলিয়ন ডলার।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা-সহ ৫০টি আন্তর্জাতিক সংস্থার ৯৯ জন বিশেষজ্ঞের তৈরি এই রিপোর্ট বলছে, ভারতে তাপপ্রবাহে মৃত্যুর সংখ্যা এই শতকের প্রথম চার বছরের তুলনায় ২০১৭ থেকে ২০২১-এর মধ্যে বেড়েছে ৫৫ শতাংশ। অতিরিক্ত তাপ খাদ্যশস্য ফলার সময় কমাচ্ছে। ২০২১-এ গরমের কারণে এ দেশে যত শ্রম-সময় নষ্ট হয়েছে, তাতে আয় হারানোর পরিমাণ জিডিপি-র (মোট জাতীয় উৎপাদন) ৫.৪ শতাংশ। গ্রামে জ্বালানি দূষণে বায়ুর গুণমানও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত বিপদসীমার চেয়ে ৩৫ গুণ উপরে। জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে স্বাস্থ্যে অগ্রাধিকার না দিলে আরও মারাত্মক সময় আসছে বলে সতর্ক করেছে রিপোর্ট।