হাতে হাত: সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের বিরোধিতায় সংবিধানের প্রস্তাবনা লেখা কাগজ হাতে মানব-বন্ধন পড়ুয়াদের। সোমবার, প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে। ছবি: সুমন বল্লভ
পার্ক সার্কাসের প্রতিবাদে শামিল বেগম আখতারিকে যখন প্রশ্নটা করা হল, ফ্যালফ্যাল করে তিনি তাকিয়ে থাকলেন কিছু ক্ষণ।
প্রাথমিক বিমূঢ় ভাব কাটিয়ে আখতারি বললেন, ‘‘সংবিধানের মানেটা ঠিক জানি না। শুধু এটুকু জানি, দেশটা যেমন ভাবে থাকার কথা ছিল, যা হওয়ার কথা ছিল, তা একটা জায়গায় লেখা রয়েছে। কিন্তু অনেকেই বলছেন, সেগুলো মানা হচ্ছে না।’’ আখতারিকে সমর্থন জানালেন তাঁর পাশে বসা মহিলাও।
শুধু কি পার্ক সার্কাসের আখতারি? লখনউয়ের ঘণ্টাঘর, দিল্লির শাহিনবাগ-সহ সারা দেশে ধর্ম, জাতি, বয়স নির্বিশেষে যাঁরা সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন (সিএএ) এবং জাতীয় নাগরিক পঞ্জির (এনআরসি) বিরোধিতায় বসেছেন, তাঁদের মতে সংবিধান হল এমন একটা ‘নিয়ম’ যা মেনে চলার কথা গোটা দেশের। কিন্তু দেশটা এখন সেই নিয়মে চলছে না।
বিদ্বজ্জনেদের একাংশ বলছেন, ‘সংবিধান’ শব্দটি যেখানে এত দিন অভিজাত, বুদ্ধিজীবী, আইনজ্ঞ, উচ্চশিক্ষিত বা রাষ্ট্রবিজ্ঞানী-সহ মুষ্টিমেয় একটা শ্রেণির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, সেখানে বর্তমানে তা প্রাত্যহিক জীবনের অংশ হয়ে গিয়েছে। দেশব্যাপী এই আন্দোলনের সামনের সারিতে সাধারণ মহিলারা রয়েছেন, যাঁরা জীবনে কখনও কোনও বিরোধিতায় যোগদান করেননি। অথচ তাঁদের হাত ধরেই ‘সংবিধান’ শব্দটি যেন একেবারে রান্নাঘরে ঢুকে পড়েছে।
ইতিহাসবিদ রজতকান্ত রায় যাকে বলছেন ‘অভূতপূর্ব’। কারণ, স্বাধীন ভারতে গণ পরিসরে সংবিধান শব্দের এমন ব্যবহার এর আগে কখনও হয়নি। দেশে জরুরি অবস্থার সময়ে ‘সংবিধান’ নিয়ে হইচই হলেও তার বিস্তার বা ব্যাপ্তি এ রকম ছিল না বলে জানাচ্ছেন তিনি। বর্ষীয়ান ওই ইতিহাসবিদের কথায়, ‘‘প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই একটা নিয়মতন্ত্র রয়েছে, যা তাঁকে বোঝায় যে জীবন, সম্পত্তি ও স্বাধীনতার সুরক্ষা প্রয়োজন। যার কথা সংবিধানে উল্লেখ রয়েছে। ফলে সংবিধানে কী লেখা রয়েছে, তা না জানলেও বর্তমান সময়ে ওই সুরক্ষা বিপন্ন হওয়ায় সর্বস্তরের মানুষ তার সঙ্গে নিজের অস্তিত্বকে মেলাতে পারছেন।’’ একই কথা বলছেন এশিয়াটিক সোসাইটির সদস্য নির্বেদ রায়ও। তাঁর কথায়, ‘‘সাধারণ মানুষ মনে করছেন, সংবিধান হল ভারতে আসা-যাওয়ার পথে একটা দিক-নির্দেশ। যেখানে সংবিধান কী, সেটা বুঝতে হবে না বা তার কতগুলি সংশোধনী হয়েছে, সেটা জানতে হবে না। কিন্তু এটুকু বোঝা যাচ্ছে, সংবিধান বলে যে বস্তুটি রয়েছে এবং যা অনুযায়ী ভারতবর্ষের চলা উচিত, সেই মতো দেশটা চলছে না। আর তারই প্রতিফলন ঘটেছে সর্বস্তরের প্রতিবাদে।’’
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক অভিজিৎ মজুমদার আবার জানাচ্ছেন, এই প্রতিবাদে ‘সংবিধান’ শব্দটির ব্যবহার কিন্তু ভাষার মাধ্যমে এগোচ্ছে না। বরং অনুভূতি দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। অভিজিৎবাবুর কথায়, ‘‘গরিব, প্রান্তিক মানুষ যখন দেখছেন শিক্ষিত সম্প্রদায় বা অল্পবয়সি পড়ুয়ারা সংবিধান শব্দটি বারবার বলছেন অথবা সংবিধান রক্ষার্থে মানবশৃঙ্খল তৈরি করছেন, তখন সেই ঘটনা সেই প্রান্তিক মানুষটির মধ্যে এক ধরনের অনুভূতির জন্ম দিচ্ছে। ফলে শব্দটির ব্যাখ্যা সামাজিক স্তর অনুযায়ী যা-ই হোক না কেন, এখানে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে ওই অনুভূতি। তাই এই সর্বব্যাপী ব্যবহার।’’
প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক প্রদীপ বসুও জানাচ্ছেন, সংবিধান রক্ষার্থে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমেছেন, এমন আগে কখনওই দেখা যায়নি। তাঁর কথায়, ‘‘সংবিধান শব্দটি একটা পবিত্রতা নিয়ে, একটা শুদ্ধতা নিয়ে যেন আমাদের সামনে এসে হাজির হয়েছে এ সময়ে।’’
শাহিনবাগ, ঘণ্টাঘর, পার্ক সার্কাস-সহ যে আন্দোলন চলছে সারা দেশ জুড়ে, সেই আন্দোলনকারীদের বৃহৎ অংশই সংবিধান শব্দের অর্থ জানেন না। কিন্তু তাঁরা এটুকু জানেন, সংবিধান হল সেই উৎস, যেখান থেকে ভারতবর্ষ জন্ম নিয়েছে। সংবিধান হল সেই শৃঙ্খল, যা হিন্দু-মুসলিম-জৈন-খ্রিস্টান-শিখ নির্বিশেষে তাঁদের একটিমাত্র পরিচয়ে বেঁধেছে, যার নাম ভারতবর্ষের নাগরিক।— ‘উই, দ্য পিপল অব ইন্ডিয়া...।’ ‘আমরা, ভারতের জনগণ...।’