বুধবার কুম্ভমেলায় পদপিষ্টের ঘটনায় উদ্ধারকাজে পুলিশ-প্রশাসন। ছবি: পিটিআই।
১৯৫৪ সাল। ব্যবসায় সর্বস্বান্ত স্বামীর অবস্থা ফেরানোর ব্রত নিয়েছিলেন দক্ষিণ কলকাতার বালিগঞ্জের বাসিন্দা উমা ভট্টাচার্য। অনেকের সঙ্গে কলকাতা থেকে ইলাহাবাদ (বর্তমানের প্রয়াগরাজ)-এর কুম্ভে পুণ্যস্নান করতে গিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু আর ফেরেননি। কোথায় গেলেন তিনি, আদৌ বেঁচে আছেন কি না, তা জানতেই পারেনি উমার পরিবার। তবে সে বার কুম্ভে একটি পদপিষ্টের ঘটনা ঘটেছিল। তাতে প্রাণ গিয়েছিল অন্তত ৫০০ জনের। জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই পারিবারিক ভাবে এ কথা শুনে এসেছেন তাঁর দৌহিত্র সুমিত ভট্টাচার্য। বুধবার প্রয়াগরাজের মহাকুম্ভে আবার একটি পদপিষ্টের ঘটনা ঘটেছে। তাতে মৃত্যু হয়েছে অনেকের। আর এই ঘটনাই উস্কে দিয়েছে প্রায় ৭০ বছর ধরে জমে থাকা সুমিতের পারিবারিক স্মৃতি। সুমিতের মায়ের বয়স তখন ১০ বছর। সেই সময়েই তাঁর দিদিমা কুম্ভে গিয়ে ‘নিখোঁজ’ হন। ছোট থেকে সুমিত তাঁর মা কৃষ্ণাদেবীর থেকেই ১৯৫৪ সালের কুম্ভের দুর্ঘটনার কথা শুনে বড় হয়েছেন। সেই দুর্ঘটনায় সুমিতের মায়ের মতো বহু জন স্বজনহারা হয়েছিল। মধ্যবয়সি সুমিত যদিও বিশ্বাস করেন, ১৯৫৪ সালের কুম্ভমেলায় পদপিষ্ট হয়ে মৃত্যু হয়েছে তাঁর দিদিমার। তবে এর কোনও প্রমাণ তাঁর কাছে নেই।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রথম ১৯৫৪ সালে প্রয়াগরাজে কুম্ভের আয়োজন করা হয়েছিল। ভারতে তখন নতুন সরকার। বড় দুর্ঘটনা মোকাবিলা করার পর্যাপ্ত ব্যবস্থাও ছিল না। ওই বছরের ৩ ফেব্রুয়ারি মৌনী অমাবস্যা উপলক্ষে কোটি কোটি মানুষের জমায়েত হয়েছিল ইলাহাবাদের মেলাপ্রাঙ্গণে। সেই ভিড়েই পদপিষ্টের ঘটনায় ৫০০ জনের বেশি পুণ্যার্থীর মৃত্যু হয়েছিল।
তার পরে দেশে সরকার সাবালক হয়েছে ধীরে ধীরে। কিন্তু কুম্ভস্নানে গিয়ে পদপিষ্ট হওয়ার ঘটনা বেড়েছে। ১৯৮৬ সালের কুম্ভতেও পদপিষ্টের ঘটনা ঘটে। ওই বছর হরিদ্বারে কুম্ভমেলা হয়। সেই কুম্ভতে পদপিষ্ট হয়ে অনেকের পুণ্যার্থীর মৃত্যু হয়। কী কারণে পদপিষ্টের ঘটনা ঘটেছিল? সেই সময়কার বিভিন্ন প্রতিবেদনে লেখা হয়েছিল, ১৯৮৬ সালের ১৪ এপ্রিল অন্যান্য রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এবং সাংসদদের সঙ্গে কুম্ভে স্নান করতে এসেছিলেন উত্তরপ্রদেশের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বীর বাহাদুর সিংহ। তাঁদের নিরাপত্তার কারণে সাধারণ পুণ্যার্থীরা নদীর কাছাকাছি পৌঁছতে বাধা পান বলে অভিযোগ ওঠে। আর তাতেই ভিড় নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। বিভিন্ন সূত্রের দাবি, পদপিষ্টের ঘটনায় সে বার ২০০ জনের বেশি পুণ্যার্থীর মৃত্যু হয়েছিল।
১৯৮৬ সালের পর দীর্ঘ সময় কুম্ভমেলায় কোনও পদপিষ্টের ঘটনা ঘটেনি। তবে ২০০৩ সালে নাসিকে অনুষ্ঠিত কুম্ভমেলায় পদপিষ্টের ঘটনা ঘটে। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে দাবি করা হয়, সেই দুর্ঘটনায় অন্তত ৩৯ জনের মৃত্যু হয়েছিল। আহত হন শতাধিক।
২০১০ সালের কুম্ভতেও পদপিষ্টের ঘটনা ঘটে। সে বছর হরিদ্বারে আয়োজিত হয়েছিল কুম্ভমেলা। ১৪ এপ্রিল, ২০১০ সালে ‘শাহি স্নানে’র সময় বিপর্যয় ঘটে। ‘শাহি স্নান’ করতে আসা সাধুসন্তদের সঙ্গে সাধারণ পুণ্যার্থীদের সংঘর্ষ বেধে গিয়েছিল। তাতেই পদপিষ্টের ঘটনা ঘটে। সে বছর সাত জনের মৃত্যু হয়েছিল।
ঠিক তার তিন বছর পর ২০১৩ সালে প্রয়াগরাজের কুম্ভে বড় দুর্ঘটনা ঘটে। তবে সে বার মেলাপ্রাঙ্গণে নয়, দুর্ঘটনা ঘটেছিল ইলাহাবাদ স্টেশনে। পদপিষ্টের ঘটনায় ৪২ জনের মৃত্যু হয়েছিল। সেই বছর ইলাহাবাদ স্টেশনে একটি ফুটব্রিজের রেলিং ভেঙে বিপত্তি ঘটে। রেলিং ভেঙে পড়ায় স্টেশনে থাকা যাত্রীদের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। পদপিষ্ট হয়ে মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। মৃতদের মধ্যে বেশির ভাগই ছিলেন মহিলা।
২০১৩ সালের পর ২০২৫। পদপিষ্টের ঘটনায় অনেকের মৃত্যুর আশঙ্কা করা হচ্ছে। আহত আরও অনেকে হাসপাতালে ভর্তি। স্বজনদের খোঁজে এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে ছোটাছুটি করছেন বহু পুণ্যার্থী। পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন প্রধানমন্ত্রী থেকে উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ-সহ সকলেই। অন্য দিকে, বিরোধীরা চরম অব্যবস্থার অভিযোগ তুলে সরব হয়েছে। তবে কুম্ভে দুর্ঘটনার বিষয় নতুন নয়। বিশ্বের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় অনুষ্ঠান কুম্ভমেলা। অতীতেও পদপিষ্টের ঘটনা ঘটেছে এই ধর্মীয় অনুষ্ঠানে।